সদরের গেটের বাইরে বাবা-মায়েদের ভিড়৷ তাঁদের চোখ সাদা-কালো পোশাকের ভিড়ে নিজের-নিজের ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে৷
স্কুল ছুটির সময় এই ভাঙাচোরা সরু রাস্তাটা সাইকেল, সাইকেল রিকশা আর স্কুটারে ছয়লাপ হয়ে যায়৷ যানজট চলে অন্তত আধঘণ্টা৷ এখন, বর্ষার সময়, তাই অবস্থা একেবারে বেহাল৷
স্কুল ছুটি হয়ে গেলেও অচ্যুতরা কয়েকজন ক্লাস থেকে বেরোয়নি৷ অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে রাজীবের ব্যাপারে অচ্যুত ঠিক কী কী বলবে তাই নিয়েই জল্পনা-কল্পনা চলছিল৷ রাজীব কুলদীপ-অচ্যুতদের হাত ধরে একেবারে কেঁদে পড়ল : ‘তোরা আমাকে যেভাবে হোক সেভ কর৷’ প্রায় আধঘণ্টা পর ওরা ক্লাসরুম থেকে বেরোল৷
কুলদীপরা সবাই চলে গেল৷ পিঠে বই-খাতার ব্যাগ ঝুলিয়ে অচ্যুত একা রওনা হল টিচার্স রুমের দিকে৷ যাওয়ার আগে ও কুলদীপকে বলল, ‘রাজীবের ব্যাপারে অমিয়স্যারের সঙ্গে কী কথা হল আমি তোকে রাতে ফোন করে জানাব৷ টা-টা!’
অচ্যুত খেয়াল করেনি কখন যেন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে৷ একটু আগের হুল্লোড় হইচই থেমে গিয়ে এখন সব একেবারে নিঝুম! শুধু বৃষ্টি ঝিরঝির করে পড়ছে৷ বাইরে কলাগাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটার টপটপ শব্দ হচ্ছে৷ দূর থেকে সাইকেল রিকশার ‘প্যাঁকপ্যাঁক’ ডাক শোনা যাচ্ছে৷ আর কখনও-কখনও মেঘের ‘গুডুম-গুডুম’৷
ছুটির পর স্কুল থেকে সবাই চলে যায়৷ তখন বানজারা স্কুলের সব ঘর ঘুরে-ঘুরে আলো আর পাখা অফ করে, দরজায়-দরজায় তালা দেয়৷ তারপর স্কুল বিল্ডিং-এর কোলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে নিজের ঘরে যায়৷ ওর ছোট্ট ঘর স্কুল-বাড়ির লাগোয়া, অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া৷ পাশেই একটা টিউবওয়েল৷ আর তাকে ঘিরে নানান গাছপালা৷ বর্ষায় সেগুলো সব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷
টিউবওয়েল থেকে একটু দূরেই একটা ছোট গোয়ালঘর৷ সেখানে বানজারার পোষা গোরু রামুয়া আর ছোট একটা বাছুর আছে৷ ওরা বেশির ভাগ সময়েই মাঠে ঘুরে বেড়ায়, ঘাস-পাতা খায়৷
বানজারা বউ নিয়ে থাকে৷ ওর বউ স্কুলের সুইপারের কাজ করে৷ সবসময় পান খায়, আর মাথায় ঘোমটা টেনে থাকে৷
টিচার্স রুমের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় অচ্যুতের বুটজুতোর খটখট শব্দ করিডরে কেমন যেন ফাঁপা প্রতিধ্বনি তুলছিল৷ একতলা থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ শোনা যাচ্ছিল৷ বানজারা ওর কাজ শুরু করে দিয়েছে৷
টিচার্স রুমের কাছে এসে অচ্যুত অবাক হয়ে গেল৷ ঘর খাঁ-খাঁ করছে৷ কেউ নেই৷
ঘরে আলো জ্বলছে, পাখা ঘুরছে৷ খোলা জানলা দিয়ে ঘোর কালো মেঘ, গাছপালা আর বৃষ্টি চোখে পড়ছে৷ দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের পাতা হাওয়ায় উড়ছে৷
তা হলে কি বৃষ্টি আসার ভয়ে অমিয়স্যার একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছেন?
এমন সময় একটা শব্দ অচ্যুতের কানে এল৷
মেঝেতে খুচরো পয়সা পড়ে যাওয়ার শব্দ৷
টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে নজর ধারালো করল অচ্যুত৷ সামান্য কুঁজো হয়ে টেবিলের নীচ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল৷
খুচরো পয়সা কোথায় পড়ল? কার পকেট থেকে পড়ল?
ঝুঁকে পড়ে নীচু হতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল অচ্যুত৷
সত্যবানস্যার দেওয়ালের গায়ে টিকটিকির মতো হেঁটে বেড়াচ্ছেন!
মেঝে থেকে অন্তত হাতদুয়েক ওপরে মেঝের সঙ্গে সমান্তরালভাবে স্যারের শরীরটা আঠার মতো আটকে রয়েছে৷ ঠিক সাঁতার দেওয়ার ভঙ্গিতে তিনি এগিয়ে চলেছেন৷
এরকম একটা মজার দৃশ্য দেখে অচ্যুতের হাসি পাওয়ার কথা৷ কিন্তু ও ভয় পেল৷ ওর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল, বুকের ভেতরে বাতাস আটকে গেল৷ কারণ, সত্যবানস্যারের মুখে এক অদ্ভুত নিষ্ঠুর উল্লাস৷ ঠোঁটজোড়া লাল টুকটুক করছে, চোখে এক অলৌকিক সবুজ আলো৷
আর ঠিক তখনই কড়-কড়-কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল কোথাও৷ অচ্যুত চমকে উঠল৷ ওই অবস্থাতেও ও বুঝতে পারল খুচরো পয়সাগুলো স্যারের পকেট থেকেই পড়েছে৷
এরকম একটা বিচিত্র ভয়ংকর দৃশ্য অচ্যুতকে পাগল করে দিল৷ ও হেঁচকি তুলে শ্বাস টানল, বুক ভরে বাতাস নিতে চাইল৷ তারপরই ছুট লাগাল দোতলার বারান্দা ধরে৷ ওর বুটের শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল কোনও পাগলা ঘোড়া মৃত্যুভয়ে ছুটে পালাচ্ছে৷
অচ্যুত যদি পিছন ফিরে তাকাত তা হলে দেখতে পেত সত্যবানস্যার ওর হেঁচকির শব্দে দেওয়ালের গা থেকেই মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছেন৷ সবুজ আগুনভরা চোখে ওর ছুটে পালানো দেখছেন৷
আর স্যারের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রহস্যময় হাসি৷
.
৷৷তিন৷৷
পরদিন সাইকেল চালিয়ে স্কুলের গেটে পৌঁছে অচ্যুতের মনে হচ্ছিল গতকাল ও যা দেখেছে সবটাই স্বপ্ন—অথবা দুঃস্বপ্ন৷
রং-চটা সীমানা-পাঁচিলের গায়ে বসানো জং-ধরা লোহার গেটের একটা পাল্লা খোলা৷ অচ্যুত সাইকেল থেকে নেমে পড়ল৷ তারপর সাইকেলটা হাঁটিয়ে ভেতরে ঢুকল৷
মাঠের এখানে-সেখানে বৃষ্টির জল জমে রয়েছে৷ মাঝখানের খানিকটা ফাঁকা জায়গা বাদ দিলে মাঠের বাকি অংশে বড়-বড় ঘাস আর আগাছা৷ এ ছাড়া পাঁচিলের ধার ঘেঁষে কয়েকটা বট, অশ্বত্থ, কদম, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু গাছ৷ আর প্রকাণ্ড জামগাছটা আছে বানজারাদের ঘরের কাছাকাছি৷ গরমকালে পাকা জাম পড়ে-পড়ে গাছের নীচটা বেগুনি হয়ে থাকে৷ গাছটার নীচে বসার জন্য কয়েকটা সিমেন্টের বেদি আছে৷
বৃষ্টি না হলে এই মাঠেই স্কুলের প্রেয়ার হয়৷ আর বৃষ্টি হলে যার-যার ক্লাসরুমে৷