‘কী রে, কী হয়েছে!’
ওরা হাঁফাতে-হাঁফাতে রাজীব দাসের কীর্তির কথা বলল৷
অমিয়স্যার ধৈর্য ধরে সব শুনলেন৷ ব্যাপারটা ওঁর মনে পড়ে গেল৷ তিনিই ওদের বলেছিলেন চোরকে হাতেনাতে ধরার কথা৷
তিনি রাজীবকে বললেন, ‘তুই এখানে থাক৷’ তারপর অচ্যুতদের দিকে ফিরে : ‘তোরা শ্রেণিতে যা৷ আমি ব্যাপারটা দেখছি—৷’
এমন সময় সত্যবানস্যার ওদের পাশ দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন৷ কিন্তু আশ্চর্য, ওদের জটলা নিয়ে কোনওরকম কৌতূহল দেখালেন না৷ একজন অচেনা মানুষের মতো পাশ দিয়ে চলে গেলেন৷ অথচ দু-তিনদিন আগেও অচ্যুতকে দেখলে হেসে বলতেন, ‘কী রে, দিনরাত শুধু ক্রিকেট নিয়ে পড়ে আছিস, নাকি অঙ্ক-টঙ্কও একটু-আধটু হচ্ছে? ভালো করে পড়৷ মাধ্যমিকে অঙ্কে একশোয় একশো পাওয়া চাই-ই চাই৷’
অচ্যুত বেশ অবাক হয়ে গেল৷ কয়েক সেকেন্ড ধরে ও সত্যবানস্যারের চলে যাওয়া দেখল৷
আর ঠিক তখনই টিফিন শেষ হওয়ার ঘণ্টা বেজে উঠল৷ ঢং-ঢং-ঢং-ঢং৷ স্কুলের দারোয়ান বানজারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল পিতলের ঘণ্টায় কাঠের হাতুড়ি দিয়ে তাল ঠুকে জানিয়ে দিচ্ছে টিফিনের আধঘণ্টা শেষ হয়েছে৷ এখন আবার ক্লাস শুরু হবে৷
ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ার সময় অচ্যুতের এরকম একটা পিতলের ঘণ্টা কেনার খুব শখ হয়েছিল৷ কিন্তু বাপি আর মা সেই শখের কথাটা শুনে হেসে এমন গড়িয়ে পড়েছিল যে, অচ্যুতের আর ঘণ্টা কেনা হয়ে ওঠেনি৷
স্কুলের চওড়া বারান্দা ধরে ওরা ক্লাসের দিকে ফিরে যাচ্ছিল৷ এখন দুপুর হলেও আকাশ মেঘলা৷ যখন-তখন বৃষ্টি হতে পারে৷ গত ক’দিন ধরেই ঝেঁপে বৃষ্টি চলছে৷ মাঝে-মাঝে এক-আধ-ঘণ্টার বিরতি৷ বৃষ্টিও বোধহয় তখন টিফিন করতে যায়—নয়তো ঘুমিয়ে পড়ে৷
স্কুলের মাঠটা বৃষ্টিতে যাচ্ছেতাই হয়ে থাকে বলে এখন টিফিনের সময়ে খেলার হুল্লোড় অনেকটা মিইয়ে গেছে৷ আর সবসময় মেঘলা থাকলে অচ্যুতের কেমন যেন মনখারাপ লাগে৷
ফিফথ পিরিয়ডের দশ-পনেরো মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর রাজীব ক্লাসে এসে ঢুকল৷
রমেশস্যার তখন ইতিহাস পড়াচ্ছিলেন, আর ক্লাসের অর্ধেক ছেলে তন্দ্রার টানে ঢুলছিল৷ ঘন-ঘন হাই উঠছিল সকলের৷
কিন্তু রাজীব দাসকে দেখেই সবাই সোজা হয়ে বসল৷
রাজীবের রং টকটকে ফরসা৷ ঘি-মাখন খাওয়া গোলগাল নধর চেহারা৷ চোখে চশমা৷ সবসময় ফিটফাট থাকে৷ কিন্তু এখন ওর চুল উসকোখুসকো, চোখের জল চশমার ফাঁক দিয়ে গাল বেয়ে নেমে এসেছে, হেঁচকি তুলে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে৷
রমেশস্যার দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন সাম্রাজ্যের সাতকাহন থামিয়ে অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার? তুই কোথায় গিয়েছিলি?’
প্রশ্নটা করে কুতকুতে তীক্ষ্ণ চোখে তিনি রাজীবকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলেন৷
‘অমিয়স্যার আমাকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন৷’ ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল রাজীব৷
‘কেন রে? কী করেছিস তুই?’
রাজীব চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল৷
অচ্যুতের ভীষণ খারাপ লাগছিল৷ আহা রে! হেডস্যার মোহনলালবাবু নিশ্চয়ই ওকে বেত দিয়ে মেরেছেন৷ কিন্তু রাজীবই-বা টাকা চুরি করে কেন? ওরা তো বেশ বড়লোক! রেল স্টেশনের কাছে ওদের সুন্দর দোতলা বাড়ি৷ মারুতি জেন গাড়ি করে স্কুলে আসে৷
মনিটর বাসবকে ডেকে রমেশস্যার ব্যাপারটা জানতে চাইলেন৷ রাজীবকে বললেন, ‘তুই ডেস্কে গিয়ে বোস৷’
রাজীব মাথা নীচু করে ডেস্কের দিকে এগোল৷
অচ্যুতের ডেস্কের সারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাজীব ওকে মিনমিনে গলায় বলল, ‘ছুটির পর তোকে অমিয়স্যার দেখা করতে বলেছেন৷’
অচ্যুত ঘাড় নেড়ে ‘আচ্ছা’ বলল৷
রমেশস্যার বাসবের কাছে গোটা গল্পটা শুনে তারপর আবার সাতবাহন রাজবংশের কাহিনি শুরু করলেন৷
রমেশস্যারের পিরিয়ড শেষ হতেই সবাই রাজীবকে ছেঁকে ধরল৷ কেউ-কেউ ওকে সান্ত্বনা দিল৷ আবার কেউ বলল, ‘ঠিক হয়েছে—অন্যায় করেছে তাই শাস্তি পেয়েছে৷’
কুলদীপ, সৌরভ, বাসবরা খুঁটিয়ে জানতে চাইল অমিয়স্যার ওকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর ঠিক কী-কী হয়েছে৷
রাজীব থতিয়ে-থতিয়ে বলছিল আর ফুঁপিয়ে উঠছিল৷ হেডস্যারের দশ ঘা বেতের বাড়ি খেয়ে ও সহ্য করেছে৷ কিন্তু হেডস্যার বলেছেন, কাল ওর বাবা-মাকে স্কুলে এসে দেখা করতে৷ এটা ওকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছে৷ বাপি-মাম্মি এসব ঘটনা জানতে পারলে ওকে হয়তো বাড়ি থেকেই বের করে দেবে৷ রাজীব তাই ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে সিঁটিয়ে গেছে৷
কুলদীপদের ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল৷ ওরা রাজীবকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘দাঁড়া, দেখছি কী করা যায়৷ তুই চিন্তা করিস না৷’
সব শুনে অচ্যুত বলল, ‘অমিয়স্যার তো আমাকে ছুটির পর ডেকেছেন৷ তখন আমি স্যারকে বলব৷ হেডস্যারকে যেন রিকোয়েস্ট করেন—যাতে গার্জেন কল না হয়৷’
অচ্যুতের কথায় রাজীব তেমন ভরসা পেল বলে মনে হল না৷
চারটে বেজে দশমিনিটে বানজারা ছুটির ঘণ্টা বাজাল৷
বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে নানান ক্লাসের ছেলের দল পিলপিল করে বেরিয়ে এল ক্লাসরুমের বাইরে৷ তারপর স্কুল-বাড়ি ছেড়ে মাঠে নেমে এল ‘সাদা জামা কালো প্যান্টের’ ভিড়৷ সেখান থেকে সদরের লোহার গেট৷ আবার গেট পেরিয়ে রাস্তা৷
আকাশ মেঘে কালো হয়ে এসেছে৷ এখনই বোধহয় আবার বৃষ্টি নামবে৷
স্কুলের মাঠের একপাশে সারে-সারে দাঁড় করানো সাইকেল৷ এক ঝাঁক ছেলে হইহই করে ছুটল সাইকেলের দিকে৷ নীচু ক্লাসের কয়েকটা ছেলে জল-কাদাভরা মাঠে ছুটোছুটি করে খেলতে লাগল৷ মাঠের এখানে-ওখানে জমে থাকা জলের ওপর পা ফেলে দাপিয়ে ছুটে গিয়ে কাদা-জল ছিটকে দিতে লাগল চারপাশে৷