অচ্যুতরা আন্দাজ করতে পারল ‘তস্কর’ আর ‘নক্তচর’ মানে চোর৷ অমিয়স্যারকে নিয়ে এই এক মুশকিল! বাংলার স্যার বলে বড্ড বেশি বাংলায় কথা বলেন৷
পরদিন থেকে ওরা পাঁচজন—অচ্যুত, কুলদীপ, প্রতীক, বাসব, আর সৌরভ—চোর ধরার নানান মতলব আঁটতে লাগল৷
এসব ব্যাপারে কুলদীপ ওদের লিডার৷ আর প্রতীক কুলদীপের সর্বক্ষণের সাথী৷ মাঝে-মাঝে কুলদীপকে দুষ্টু বুদ্ধির জোগান দেয় বলে প্রতীকের একটু কুখ্যাতি আছে৷ বাসব ক্লাসের মনিটর, এন. সি. সি-র ক্যাডেট৷ ডিসিপ্লিন নিয়ে সবসময় মাথা ঘামায়৷ হাঁটা-চলা করে সৈনিকের ঢঙে—যেন লেফট-রাইট করে প্যারেড করছে৷ ক্লাসের অনেকেই ওর হাঁটার ঢং নকল করে ওকে ব্যঙ্গ করে—তবে আড়ালে৷ নইলে ও স্যারদের কাছে কমপ্নেন করে দেবে৷ আর যেহেতু সৌরভের ব্যাগ থেকে চবিবশ টাকা চুরি গিয়েছিল, তাই চোর ধরার মতলবে ও একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷
টিফিনের সময় স্কুলের লাগোয়া খেলার মাঠে জামগাছতলায় বসে ওদের প্ল্যান আঁটার কাজ শুরু হল৷
টিফিনের সময় অচ্যুতরা বেশির ভাগই ক্লাসরুম ছেড়ে খেলার মাঠে বেরিয়ে আসে৷ টিফিনটা কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে ওদের কলরোল খেলাধুলো শুরু হয়৷ ওদের চেঁচামেচিতে গাছে বসে থাকা বুলবুলি, শালিখ, বসন্তবৌরি আর দোয়েল পাখিরা উড়ে পালায়৷ আধঘণ্টা পর ক্লাস বসলে মাঠটা হঠাৎ আবার ফাঁকা নির্জন হয়ে যায়৷ তখন পাখিরা বোধহয় হাঁফ ছেড়ে ফিরে আসে৷
চুরির ঘটনাগুলো খতিয়ে বিচার করার পর প্রতীক বলল, ‘স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, টাকাটা যে নেয় সে টিফিনের সময় নেয়৷ ক্লাসে তখন যদি অন্যরা কেউ বসে থাকে তা হলে নেয় না৷ কিন্তু ফাঁক পেলেই ব্যাগ হাতড়ায়৷ টিফিনের সময় ক্লাসরুমটা ওয়াচ করতে হবে৷’
তখন ঠিক হল, রোজ টিফিনের সময় সৌরভ ওদের ক্লাসরুমে ডেস্কের নীচে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকবে৷ ক্লাসে কেউ ঢুকলে সৌরভগেক দেখতে পাবে না৷ ফলে চোরবাবাজি ধরা পড়বেই৷
যেমন মতলব তেমনি কাজ৷ এবং ফল পাওয়া গেল তিনদিনের মধ্যেই৷
সৌরভ ক্লাসরুমে লুকিয়ে ছিল৷ ওদের ক্লাসে দুটো করে ডেস্ক পাশাপাশি তক্তা দিয়ে জুড়ে দুজনের বসার মতো ব্যবস্থা করা আছে৷ সেই জোড়া ডেস্কগুলোকে আবার পাশাপাশি সাজিয়ে ডেস্কের সারি তৈরি করা হয়েছে৷ আর ক্লাসরুমের মাঝ-বরাবর রয়েছে যাতায়াতের প্যাসেজ৷
সৌরভ ক্লাসরুমের একেবারে শেষে এককোণে একটা জোড়া ডেস্কের নীচে লুকিয়ে ছিল৷ অত বড় ঘরে আর কেউ নেই৷ সব চুপচাপ৷ শুধু তিনটে সিলিং ফ্যান ঘোরার শব্দ হচ্ছে৷ ঘাড় গুঁজে বসে থাকতে সৌরভের বেশ কষ্ট হচ্ছিল৷ কিন্তু একটা জেদ ওকে দিয়ে এই কষ্ট সইয়ে নিচ্ছিল৷
আগের দু-দিন কোনও ঘটনা ঘটেনি৷ কিন্তু আজ ঘটল৷
মিনিটদশেক যেতে না যেতেই একজোড়া পা দেখতে পেল সৌরভ৷
খুব সাবধানে দুটো ডেস্কের পায়ার একচিলতে ফাঁক দিয়ে ও উঁকি মারল৷ দেখল, ওদেরই ক্লাসের রাজীব দাস প্রথম সারির ডেস্কের ব্যাগগুলো ব্যস্তভাবে হাতড়াচ্ছে৷ কোনও-কোনও ব্যাগের ভেতর থেকে কী যেন মুঠো করে নিয়ে পকেটে ঢোকাচ্ছে৷ আর মাঝে-মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে ক্লাসরুমের দরজার দিকে তাকাচ্ছে৷
মাত্র পাঁচমিনিট৷ তার মধ্যেই দুটো ডেস্কের সারির তল্লাশি চটপট সেরে ফেলল রাজীব৷ যা পেল পকেটে গুছিয়ে নিল৷ তারপর তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল৷
না, সৌরভ ‘চোর, চোর’ বলে চেঁচায়নি৷ কারণ, সেইরকমই কথা ছিল৷ ও শুধু চুরির ঘটনাটা কুলদীপ, অচ্যুতদের জানিয়ে দিল৷ বলল, এই কুকীর্তি কার৷
এই খবরটা জানার পর কুলদীপরা চোর ধরার ফাঁদ পাতল৷ ওরা পাঁচজন টিফিনের সময় ক্লাসরুমের পাঁচ জায়গায় ডেস্কের নীচে ঘাপটি মেরে রইল৷
ওদের হতাশ হতে হল না৷ কারণ, চোর এল এবং চটপট কাজ সারতে লাগল৷
কুলদীপ সকলের আগে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল৷ ওর পিঠের ধাক্কায় একজোড়া ডেস্ক দড়াম করে মেঝেতে উলটে পড়ল৷
ও চিৎকার করে রাজীবকে জাপটে ধরল, ‘ব্যাটা চোর, রোজ বন্ধুদের টাকা চুরি করিস—লজ্জা করে না!’
ততক্ষণে সৌরভ, বাসব, প্রতীক আর অচ্যুত ওদের লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ ওরা সবাই রাজীবকে ঘিরে ধরল৷ তারপর রাজীবকে টানতে-টানতে নিয়ে গেল টিচার্স রুমে৷
এখন টিফিনের সময়৷ একটা প্রকাণ্ড টেবিল ঘিরে স্যারেরা বসেছিলেন৷ কয়েকজন গল্পগুজব করছিলেন, কেউ-কেউ টিফিন সারছিলেন৷ বেয়ারা সেবকরাম একপাশে দাঁড়িয়ে চক-ডাস্টার গুছিয়ে রাখছিল৷
টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে কুলদীপরা চট করে ঘরের ভেতরটায় চোখ বুলিয়ে নিল৷ ওদের ক্লাসটিচার ভূগোলের কালীপদস্যারকে ওরা দেখতে পেল না৷ বোধহয় কোনও কাজে বাইরে বেরিয়েছেন৷ তবে অমিয়স্যার আর সত্যবানস্যার ছিলেন৷ সত্যবানস্যার টিফিন করছিলেন৷ আর অমিয়স্যার খবরের কাগজ পড়ছিলেন৷
টিচার্স রুমের দরজায় ওদের জটলা দেখে কেউ-কেউ অবাক হয়ে দেখছিলেন৷
বাসব অমিয়স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভেতরে আসব, স্যার?’
অমিয়স্যার কাগজ থেকে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকালেন৷ কুলদীপ, সৌরভ, বাসবদের দেখে বুঝলেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে৷ কারণ, কুলদীপ রাজীবের কবজি শক্ত করে চেপে ধরে ছিল৷
চেয়ার ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অমিয়স্যার৷ খবরের কাগজটা একটা ডাস্টার চাপা দিয়ে রেখে চটপট চলে এলেন দরজার কাছে৷