ধীরে-ধীরে খাম থেকে প্রিন্টগুলো বের করল সৌরভ৷
ওরা সবাই হাঁ করে সত্যবানস্যারের ছবিগুলো গিলতে লাগল৷
অচ্যুত একটা প্রিন্ট নিজের কাছে রেখে দিল৷ মউলিকে ঘটনাগুলো যখন বলবে তখন ছবিটা দেখাবে৷
কুলদীপ বলল, ‘আমি বাসবকে একটা ফটো দেখিয়ে দেব৷’
প্রতীক বলল, ‘তোরা যদি বলিস, তা হলে রাজীবকেও দেখাব৷’
অচ্যুত বলল, ‘না, না—রাজীবকে এক্ষুনি দেখানোর দরকার নেই৷ ও আগে সেরে উঠুক, রেগুলার স্কুলে আসুক—তখন দেখানো যাবে৷’
তারপর ওরা যার-যার বাড়ির দিকে রওনা হল৷
রাজীবের কথা ভাবতে-ভাবতে অচ্যুত বাড়ি ফেরামাত্রই মা বলল, ‘একটু আগেই রাজীবের মা ফোন করেছিলেন৷ জানতে চাইছিলেন, রাজীব আমাদের বাড়িতে এসেছে কি না৷’
‘তার মানে!’ চমকে উঠল অচ্যুত৷
সঙ্গে-সঙ্গে ও রাজীবের বাড়িতে ফোন করল৷
‘হ্যালো, আন্টি, আমি অচ্যুত বলছি৷’
‘দ্যাখো না, রাজু আধঘণ্টা মতন আগে কাউকে না বলে কোথায় বেরিয়ে গেছে৷ আমি ওর ফোনবুক দেখে পসিবল সব জায়গায় ফোন করলাম৷ বাট নোবডি নোজ হোয়্যার হি ইজ৷ রাজু এখনও ভালো করে সেরে ওঠেনি—শরীর এখনও উইক…আমি যে এখন কী করি! ওর বাপি গতকাল ভাইজাগ গেছে—ফ্রাইডেতে ফিরবে…৷’ রাজীবের মাম্মির আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে গেছে৷ ওঁর গলা বেশ অসহায় শোনাচ্ছে৷
‘আচ্ছা, আজ সন্ধের পর রাজীবের কি কোনও ফোন এসেছিল?’ অচ্যুতের বুকের ভেতরে গুমগুম শব্দ শুরু হয়ে গেল৷ ও উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল৷
‘হ্যাঁ…কে একজন ফোন করেছিলেন৷ বলছিলেন, রাজুর স্যার…৷’
‘ক’টার সময় ফোনটা এসেছিল?’
‘অ্যাবাউট এইট থারটি…৷’
অচ্যুতদের কোচিং শেষ হয়েছে আটটা নাগাদ৷ তা হলে তার পরে সত্যবানস্যার রাজীবকে ফোন করে থাকতে পারেন৷
রবিবার রাজীবের সঙ্গে অচ্যুতের ফোনে কথা হয়েছিল৷ রাজীব তখন কান্নাকাটি করছিল৷ বলছিল, স্যাটাস্যাট ওকে অদ্ভুত গলায় ডাকছিল৷ ঠিক যেন নেশা ধরানো ঘুমপাড়ানি গান৷ অনেকটা নিশির ডাকের মতো৷
সেদিনটা ছিল শনিবার৷
তা হলে আজও কি সেইরকম কিছু হয়েছে? রাজীবের মাম্মি আজ আর ছেলেকে আটকাতে পারেননি৷
‘কী হল?’ রাজীবের মাম্মি ওপাশ থেকে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি কিছু বলছ না কেন?’
অচ্যুত ঠোঁট কামড়াল৷ একপলক তাকিয়ে রইল ফাঁকা দেওয়ালের দিকে৷ তারপর বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না৷ আমি খোঁজ করে দেখছি৷ কোনও খবর পেলে আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দেব৷’
‘তুমি একটু সিরিয়াসলি দ্যাখো, অচ্যুত৷ আমি ভীষণ উয়ারিড হয়ে আছি৷’
ওঁকে আবার আশ্বাস দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল অচ্যুত৷
ওর মন বলল, সত্যবানস্যারের কোচিং-ঘরে গিয়ে একবার খোঁজ করা দরকার৷
ও চটপট কুলদীপ, প্রতীক আর সৌরভকে ফোন করল৷
প্রতীককে বাড়িতে পাওয়া গেল না৷ বাকি দুজনকে ও তৈরি হয়ে সত্যবানস্যারের কোচিং-এ আসতে বলল৷
তারপর শোওয়ার ঘরে গিয়ে বাপির বালিশের পাশ থেকে তিন ব্যাটারির টর্চটা তুলে নিল৷ একবার ‘অন’ করে দেখে নিল ঠিকঠাক জ্বলছে কি না৷
টর্চ হাতে নিয়ে বেরোনোর সময় রান্নাঘরের দিকে গলা বাড়িয়ে বলল, ‘মা, আমি একটু কুলদীপের বাড়ি যাচ্ছি৷ তাড়াতাড়ি ফিরে আসব৷ তুমি দরজাটা দিয়ে দাও৷’
মা তাড়াতাড়ি খুন্তি-কড়াই সামলে রান্নাঘর থেকে বেরোতে-বেরোতে অচ্যুত সাইকেল টেনে নিয়ে রাস্তায় চলে এসেছে৷
মা সদর দরজার কাছে যখন এল তখন অচ্যুতের সাইকেল অনেকটা দূরে চলে গেছে৷ মায়ের পিছুডাক ও শুনতে পেল না৷ দরজা বন্ধ করতে-করতে মা ভাবল, অচ্যুতের বাবার কী যে এক তাসের নেশা! সে বাড়িতে থাকলে যা-হোক করে ছেলেটাকে হয়তো আটকাতে পারত৷ এই বয়েসটা যে ভালো নয়, সেটা মানুষটা বুঝলে আর চিন্তা ছিল না৷ ছেলেটা এমন তাড়াহুড়ো করে কুলদীপের বাড়ি গেল কেন, কে জানে!
মায়ের জন্য অচ্যুতের খারাপ লাগছিল৷ কিন্তু আরও খারাপ লাগছিল রাজীবের জন্য৷
জোরে প্যাডেল করে দশমিনিটের মধ্যেই ও সত্যবানস্যারের কোচিং-এ পৌঁছে গেল৷ দেখল, কুলদীপ আর সৌরভ তখনও এসে পৌঁছয়নি৷
বাড়িটার কাছ থেকে একটু দূরে সাইকেল থামিয়ে দিল অচ্যুত৷ অবাক হয়ে দেখল, কোচিং-ঘরের জানলাগুলো খোলা, কিন্তু কোনও জানলাতেই আলো চোখে পড়ছে না৷
আলো নেভানো অথচ জানলা খোলা কেন?
সাইকেল থেকে নেমে পা টিপে-টিপে কোচিং-এর দরজার দিকে এগোল অচ্যুত৷ ডানহাতের শক্ত মুঠোয় টর্চটা ধরা রয়েছে৷
রাত সবে ন’টা পেরিয়েছে, কিন্তু এই অঞ্চলটা এমন যেন ঘড়ির কাঁটা তিন ঘণ্টা এগিয়ে গেছে৷ চারপাশে অন্ধকার গাছপালার মাঝে একতলা বেখাপ্পা বাড়িটাকে আরও অন্ধকার বলে মনে হচ্ছিল৷
কোচিং-এর দরজার কাছে পৌঁছে অচ্যুত একটা হাসির শব্দ শুনতে পেল৷
এ-হাসি ওর চেনা৷ মিহি খিলখিল হাসি৷
যতটা ভয় পাওয়ার কথা অচ্যুত ততটা ভয় পেল না৷ কারণ, সত্যবানস্যার নিজেই পরশুদিন বলেছেন, ‘তোর কোনও ক্ষতি হোক আমি চাই না…৷’
স্যার নিশ্চয়ই অচ্যুতের কোনও ক্ষতি করবেন না৷
কৌতূহল ওকে টানতে লাগল৷ ঘরের ভেতর থেকে হাসির আওয়াজ আসছে কেন? কুলদীপ, সৌরভ যখন আসে আসুক—ওর একবার দেখতে ইচ্ছে করছে ঘরের ভেতরের রহস্যটা কী৷
দরজায় আলতো করে চাপ দিল অচ্যুত৷ দরজা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে গেল৷
ভেতরটা গাঢ় অন্ধকার৷ তারই মধ্যে জ্বলছে দুটো সবুজ চোখ৷ বোধহয় দরজার শব্দ পেয়েই এদিকে তাকিয়েছে৷