‘ভ-ভালো আছে৷’ চাপা শব্দের টুকরোগুলো অচ্যুতের ঠোঁট থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে এল৷
‘ওকে আমি খুব ভালোবাসি৷ অবশ্য তোকেও ভালোবাসি…৷’ স্যার দেওয়াল বেয়ে মেঝের দিকে নেমে আসতে লাগলেন : ‘তোকে ভালোবাসি তুই অঙ্কে চ্যাম্পিয়ান বলে৷ আর রাজীবকে…থাকগে, সে অন্য ব্যাপার৷’
সার্কাস শেষ করে সত্যবানস্যার শতরঞ্চির ওপরে নেমে এলেন৷ হাততালি দেওয়ার ভঙ্গিতে শব্দ করে হাত ঝাড়লেন৷ চশমাটা ঠিক করে নাকের ওপরে সেট করে বললেন, ‘কী রে, এবার তুই খুশি তো? এখন থেকে পড়ায় মন বসবে তো?’
অচ্যুত কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঘাড় নাড়ল৷ বাতাসে ঘরের জানলার পাল্লা নড়ে উঠল৷ একটা জংলি গন্ধ ঘরে ঢুকে পড়ল যেন৷
‘সবুজ চোখ কী আর দেখতে চাস?’
অচ্যুত মাথা নাড়ল এপাশ-ওপাশ৷ না, ও দেখতে চায় না৷
‘আসলে কী জানিস, এখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগ৷ সবাই শুধু প্রমাণ চায়৷ তাই আমার এসব নিজের চোখে না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না৷ প্রথম-প্রথম তো আমারই বিশ্বাস হতে চায়নি৷’ বলে মিহি গলায় খিলখিল করে হেসে উঠলেন সত্যবানস্যার৷
স্যারের গলাটা হঠাৎ বদলে যাওয়ায় অচ্যুত একটু চমকে গেল৷ দেখল, স্যার হাসতে-হাসতেই মাথাটা এপাশ-ওপাশ দোলাচ্ছেন৷ স্যারের চোখ দুটো নিজে থেকেই কেমন কটা রঙের হয়ে যাচ্ছে৷
স্যারের হাসিটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোঙানির মতো হয়ে গেল৷ তিনি খপ করে অচ্যুতের ডান হাতের কবজি চেপে ধরলেন৷ তীব্র চোখে তাকালেন ওর দিকে৷
স্যারের হাতটা কী গরম! যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!
অচ্যুত ঝটকা মেরে হাতটা টেনে ছাড়াতে চেষ্টা করল৷ পারল না৷
কেমন যেন ভাঙা খনখনে গলায় সত্যবানস্যার বললেন, ‘বাঁচতে চাস তো এক্ষুনি পালা৷ তুই অঙ্কে চ্যাম্পিয়ান৷ তোর কোনও ক্ষতি হোক আমি চাই না৷’ ওর হাতটা ছেড়ে দিলেন স্যার৷ একরকম যেন ছুড়ে দিলেন অচ্যুতের কোলে : ‘পালা! পালা শিগগিরই!’
অচ্যুত লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ একছুটে চলে গেল দরজার কাছে৷
সত্যবানস্যার তখন শরীরটাকে পিছনদিকে বেঁকিয়ে বুকে হাত বোলাচ্ছেন আর বুক-ফাটা তেষ্টায় চাপা শব্দ করছেন, ‘ওঃ! ওঃ!’
হঠাৎই নিজের ডানহাতে হিংস্র কামড় বসিয়ে দিলেন৷
অচ্যুতের মাথাটা যেন ঘুরে গেল, দরজা ধরে নিজেকে সামলে নিল৷
স্যারের চোখ দুটো গাঢ় সবুজ হয়ে গেল৷ হাত কামড়ে ধরা অবস্থাতেই তিনি অচ্যুতের দিকে মুখ তুলে তাকালেন৷ গোঙানির মতো শব্দ করে কিছু একটা বলতে চাইলেন৷ তারপর কামড়ে ধরা জায়গাটা প্রবল টানে শব্দ করে চুষতে লাগলেন৷
এতক্ষণ গলা টিপে ধরে রাখা চিৎকারটা এইবার অচ্যুতের গলা দিয়ে বেরিয়ে এল৷ একটানে দরজা খুলে ও ছিটকে চলে এল বাইরে৷ চোখ-মুখে অসহ্য তাপ৷ মাথা ঝিমঝিম করছে৷ কোনওরকমে ও ছুটে গেল শুইয়ে রাখা সাইকেলের কাছে৷ তারপর অচ্যুত নামের একটা রোবট অমানুষিক গতিতে সাইকেল ছুটিয়ে দিল৷
ঠিক তখনই ঝিরঝিরে বৃষ্টি নেমে পড়ল আকাশ থেকে৷
অচ্যুতের ভয় ক্রমশ কমছিল৷ কারণ, ও বোধহয় পালটে যাওয়া সত্যবানস্যারের ধরনধারণ এখন অনেকটা স্পষ্টভাবে আঁচ করতে পারছিল৷ বুঝতে পারছিল, সত্যবানস্যারের একটা ভয়ানক অসুখ হয়েছে৷ এ-অসুখ কখনও সারে কি না অচ্যুতের জানা নেই৷
মঙ্গলবার স্কুলের দিনটা বেশ উত্তেজনার মধ্যে কাটল৷ কারণ, পরদিনই ওরা সৌরভের তোলা ফটো দেখতে পাবে৷
অচ্যুত টিফিনের সময় সৌরভকে বলল, ‘তুই ফটোর দোকানে বলবি, ওগুলো আমাদের স্কুলের একটা নাটকের রিহার্সালের ফটো—এমার্জেন্সি প্রিন্ট দরকার৷’
প্রতীক বলল, ‘স্যাটাস্যাটকে যদি চিনে ফ্যালে?’
বাসব বলল, ‘তোদের কাছে যা শুনলাম তাতে মনে হয় স্যাটাস্যাটের মুখ ভালো করে দেখা যাবে না৷’
কুলদীপ চোখ পাকিয়ে বলল, ‘চিনতে পারল তো বয়েই গেল—৷’ তারপর বাসবের টিফিন বক্স থেকে আধখানা সন্দেশ নিয়ে মুখে পুরে দিল৷
সৌরভ বলল, ‘ফটোর প্রিন্ট হাতে এলে অমিয়স্যারকে ব্যাপারটা জানালে কেমন হয়?’
অচ্যুত বলল, ‘জানালে অমিয়স্যার হয়তো হেডস্যারকে জানাতে বলবেন৷ হেডুর সঙ্গে দেখা করতে আমার ভয় করে৷’
কুলদীপ বলল, ‘ভয়ের কী আছে! স্যাটাস্যাটের ফটো নিয়ে আমি তোর সঙ্গে হেডুর কাছে যাব৷’
‘ঠিক আছে প্রিন্টটা আগে হাতে আসুক…৷’
ওদের আলোচনা-পরিকল্পনার যেন কোনও শেষ নেই৷ স্কুলে যে-কথা শেষ হয় না সেগুলো রাতে টেলিফোনে চলতে থাকে৷
অচ্যুত যে ইদানীং ফোন বড্ড বেশি করছে সেটা ওর মায়ের নজরে পড়ল৷ এমনিতে ওরা খুব দরকার ছাড়া ফোন ব্যবহার করে না৷ কারণ, অচ্যুতের বাপিকে বেশ কষ্ট করেই ফোনের খরচ চালাতে হয়৷ তাই বাড়াবাড়িরকম ফোন করা নিয়ে মা অচ্যুতকে বারদুয়েক বকাবকি করল৷
‘মা যদি জানত কেন এত ফোন করতে হয়, তা হলে ভয়ে কেঁপে উঠত৷’ মনে-মনে ভাবল অচ্যুত৷
বুধবার সকালে ও ফোন করে রাজীবের খবর নিল৷ রাজীব এখন পুরোপুরি সেরে উঠেছে৷ তবে মনের জোর ততটা ফিরে পায়নি৷
সেদিন সন্ধেবেলা সত্যবানস্যারের কোচিং-এ সময়টা বেশ সহজ-স্বাভাবিকভাবেই কেটে গেল৷ স্যারকে দেখে কে বলবে, গত পরশু রাতে এই কোচিং-ঘরের দেওয়ালে তিনি বুকে হেঁটে বেড়িয়েছেন!
স্যার দু-তিনবার রাজীবের কথা জিগ্যেস করলেন৷ তারপর আচমকা মাথাটা পিছনদিকে হেলিয়ে বুকে কয়েকবার হাত বোলালেন৷
কোচিং-এর শেষে বাড়ি ফেরার সময় ওরা সৌরভের সঙ্গে ফটোর দোকানে গেল৷ ফটোগুলো ডেলিভারি নিয়ে ওরা একটু দূরে সরে গেল৷