বাড়ির বাইরে আলো বলতে হাতদশেক দূরে ইলেকট্রিক পোস্টের মাথায় ঝোলানো একটা বালব৷
এই আস্তানাটা ভাড়া নিয়ে সত্যবানস্যার কোচিং চালান৷
বড় ঘরটার চারটে ছোট-ছোট জানলা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছিল৷ জানলাগুলো একটু উঁচুতে হাওয়ায় শুধু ঘরের ড্যাম্প ধরা দেওয়াল চোখে পড়ছে৷
কোচিং-এর ঘর থেকে একটু দূরে সাইকেল থামাল অচ্যুত আর সৌরভ৷ আগাছার জঙ্গলের ওপরে সাইকেল দুটো ওরা কাত করে শুইয়ে দিল৷ তারপর অচ্যুত নীচু গলায় সৌরভকে বলল, ‘তুই আস্তে- আস্তে পেছনদিকে চলে যা৷ সাবধানে জানলা দিয়ে উঁকি মারবি৷ যেই দেখবি স্যাটাস্যাট পিকিউলিয়ার কিছু করছে অমনি ফটো তুলে নিবি৷ শিয়োর হওয়ার জন্যে দরকার হয় দু-তিনটে শট নিবি৷ তারপর সোজা সাইকেল নিয়ে পালাবি—কোনওদিকে তাকাবি না৷ রাতে তোর সঙ্গে আমি ফোনে কথা বলে নেব৷’
সৌরভের মুখে আলো-ছায়া নড়ছিল৷ ওকে একটু যেন বিভ্রান্ত দেখাল৷ ও জিগ্যেস করল, ‘স্যাটাস্যাট হঠাৎ পিকিউলিয়ার কিছু করবে কেন?’
অচ্যুত কোচিং ক্লাসের দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই বলল, ‘সে-দায়িত্ব আমার৷ তুই যা—রেডি হয়ে থাক…৷’ সৌরভকে ঠেলা মারল অচ্যুত৷
সৌরভ পা টিপে-টিপে বাড়ির পিছনদিকে চলে গেল৷
আর অচ্যুত সটান হেঁটে গিয়ে কোচিং ক্লাসের ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল৷ ওর বুকের ভেতরে যে মেঘ গুড়গুড় করছিল সেটাকে ও জোর করে ভুলে যেতে চাইল৷
‘স্যার—৷’
অচ্যুতের ডাকে সত্যবানস্যার চোখ তুলে তাকালেন৷
ঘরে আর কেউ নেই৷ মেঝেতে পাতা শতরঞ্চির ওপরে বসে স্যার খাতা দেখছেন৷
খুব শিগগিরই স্কুলে কোনও পরীক্ষা হয়নি৷ এগুলো নিশ্চয়ই স্যারের কোচিং-এ নেওয়া পরীক্ষার খাতা৷
‘তুই হঠাৎ এসময়ে?’
‘স্যার, আপনার কথা আমি কাউকে বলিনি৷’
হাসলেন সত্যবানস্যার : ‘আয়, আয়—এখানে এসে বোস৷’
অচ্যুত দরজার কাছে চটি ছেড়ে শতরঞ্চির ওপরে গিয়ে বসল৷ চোখের আন্দাজে মেপে দেখল স্যারের কাছ থেকে ওর দূরত্ব মাত্র তিন হাত৷
স্যারকে লক্ষ করছিল অচ্যুত৷ তেলচকচকে চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো৷ কিন্তু মাথা ঝুঁকিয়ে থাকায় কয়েকগোছা চুল চশমার ওপরে ঝুলে পড়েছে৷ পাশ থেকে স্যারের নাকটাকে আরও খাড়া মনে হচ্ছে৷ আর গলার পাশে একটা শিরা ফুলে রয়েছে৷
শিরাটার ওপরে চোখ পড়তেই অচ্যুতের বুকের ভেতরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল৷ ওর ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল৷ কিন্তু মনের জোরে ইচ্ছেটাকে ও রুখে দিল৷ রাজীবের কথা মনে করে ও চোয়াল শক্ত করল৷
সত্যবানস্যার আবার মাথা নীচু করে খাতা দেখছিলেন৷ সেই অবস্থাতেই জিগ্যেস করলেন, ‘তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? তুই আমার সবচেয়ে ফেভারিট স্টুডেন্ট…৷’
‘পড়াশোনায় একদম মন বসছে না, স্যার৷’ অনুযোগ করে বলল অচ্যুত৷
‘কেন রে?’ স্যার খাতার দিক থেকে চোখ সরালেন না৷
‘আপনার জন্যে৷’
চমকে চোখ তুলে তাকালেন : ‘তার মানে!’
‘আপনার…ইয়ে…ওইগুলো আমি এখনও…মানে…বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না৷ মনে হচ্ছে, আমি সত্যি-সত্যিই ভুলভাল দেখেছি৷ আপনি কী করে দেওয়ালে হাঁটবেন! কী করে আপনার চোখ সবুজ হবে! অসম্ভব!’ একদমে কথাগুলো বলে গেল অচ্যুত৷
‘ভুলভাল? অসম্ভব?’ হাতে ধরা লাল পেন ছেড়ে দিলেন সত্যবানস্যার৷ ওঁর টকটকে ফরসা গালে অপমানের রক্ত ছুটে এল৷ কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে কোমলভাবে হাসলেন : ‘যাকগে, ওসব কথা ছাড়৷ তুই কী দরকারে এসেছিল বল…৷’
‘আপনি রাগ করবেন না, স্যার৷ ওরকম অলৌকিক ব্যাপার…তাই সত্যি বলে মানতে কষ্ট হচ্ছে৷ আমি এরকম ভুল দেখলাম! আমি, স্যার, ঠিক বলে বোঝাতে পারছি না…৷’
সত্যবানস্যার স্নেহের হাসি হাসলেন৷ বললেন, ‘বুঝেছি…বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে তোর মেন্টাল ডিসটারবেন্স হচ্ছে৷ তা কী করলে তুই খুশি হবি? কী করলে তোর পড়ায় মন বসবে?’
কয়েকবার ঢোঁক গিলল অচ্যুত৷ তারপর দমকা হাওয়ার মতো বলে বসল, ‘আমাকে আর-একবার করে দেখাবেন, স্যার?’
অদ্ভুত হেসে সত্যবানস্যার উঠে দাঁড়ালেন৷ স্যারকে অনেক লম্বা দেখাচ্ছিল৷ অচ্যুতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ব্যস, এই?’
অচ্যুত দম বন্ধ করে ঘাড় নাড়ল৷ বলতে চাইল, ‘হ্যাঁ—এই৷’
স্যার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিলেন৷ তারপর শূন্যে কয়েকবার হাত নেড়ে দরজার পাশের দেওয়ালে থাবা বসিয়ে দিলেন৷ এবং টিকটিকির মতো দেওয়ালে শরীরটাকে লেপটে সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে এগোতে লাগলেন৷
অচ্যুতের শীত করতে লাগল৷ ওর মনে হল, একটা কদাকার সরীসৃপ দেওয়ালে কিলবিল করছে৷ একটা ভয়ের চিৎকার ওর গলা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল৷ প্রাণপণ চেষ্টায় অচ্যুত সেটাকে রুখে দিল৷ আর মনের জোরে শতরঞ্চির ওপরে স্থির হয়ে বসে রইল৷
মাথার ওপরে পুরোনো সিলিং পাখার খটখট আওয়াজ হচ্ছিল৷ কিন্তু তারই মধ্যে অচ্যুত যেন কয়েকবার অটোমেটিক ক্যামেরার ‘চিঁউ-চিঁউ’ শব্দ শুনতে পেল৷
স্যার দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন৷ সেই অবস্থাতেই ঘাড় কাত করে হাসিমুখে অচ্যুতের দিকে তাকালেন : ‘কিছুদিন আগে যখন এই ক্ষমতাটা আবিষ্কার করি তখন খুব তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম, বুঝলি৷ তারপর খেয়াল করলাম, আমার মনের ভেতরে কেমন একটা তোলপাড় চলছে৷ কখনও অঙ্ক মনে থাকে, কখনও থাকে না৷ কখনও চেনা লোককে চিনতে পারি, কখনও পারি না৷ প্রথম-প্রথম একটু অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু দু-একদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা সয়ে গেল৷ আর…৷’ স্যার সিলিং-এর দিকে বেয়ে উঠতে লাগলেন : ‘…আর অদ্ভুত একটা তেষ্টা শুরু হল৷ যখন তেষ্টা পায় তখন কোনও জ্ঞান থাকে না৷ তখন তো আর আমি আমি থাকি না! আবার যখন তেষ্টা পায় না তো পায় না৷ অ্যাই, রাজীব কেমন আছে রে?’