‘সেইজন্যেই তোকে ফোন করেছি৷ একটুও ভয় পাবি না—আমরা শিগগিরই যা-হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করছি৷ স্যাটাস্যাটের কেসটা আমরা এসপার-ওসপার করে ছাড়ব৷’
‘শোন…একটা ব্যাপার…মানে…৷’ থতিয়ে থতিয়ে বলতে চাইল রাজীব৷
‘কী হয়েছে?’
‘স্যাটাস্যাট কাল রাতে আমাকে ফোন করেছিল…৷’
‘বলিস কী!…কী বলল?’ অচ্যুতের বুকের ভেতরে ড্রাম বাজতে শুরু করল৷
‘আমাকে ওর কোচিং-এ যাওয়ার কথা বলছিল৷’
‘সে কী! কাল তো কোচিং ছিল না৷’
‘সেইজন্যেই তো ডাকছিল৷ বলছিল, আমার সঙ্গে ওর একা-একা কী দরকার…তাই…৷’
‘খবরদার যাবি না!’ চেঁচিয়ে উঠল অচ্যুত৷
‘শেষ পর্যন্ত মাম্মির ধমক খেয়ে যাইনি৷ তবে…তবে ভীষণ যেতে ইচ্ছে করছিল…৷’ অপরাধীর সুরে বলল রাজীব, ‘তুই বিশ্বাস করবি না, স্যার কীরকম অদ্ভুত গলায় আমাকে ডাকছিলেন৷ ঠিক যেন নেশা ধরানো ঘুমপাড়ানি গান৷ অনেকটা গল্পের নিশির ডাকের মতো৷ বারবার বলছিলেন, ‘‘আসতে তোকে হবেই৷ আমার ডাক তুই ফিরিয়ে দিতে পারবি না৷ আজ না হয় কাল তোকে আসতেই হবে৷ আমার তেষ্টা তোর রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দেবে, তোকে পাগল করে দেবে৷ তোর আমার যে রক্তের সম্পর্ক, তাকে কখনও ছিন্ন করা যায় না৷ কখখনও না৷’’
‘…তুই বিশ্বাস কর, অচ্যুত—আমি তখন মাতালের মতো হয়ে গিয়েছিলাম৷ স্যার ছাড়া আমি আর তখন কিচ্ছু ভাবতে পারছিলাম না৷ মাথাটা হঠাৎ কেমন টলে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম৷ টেবিলের একটা কোনা ধরে সামলে নিলাম৷ মাম্মি একটু দূরে বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল৷ আমাকে টলে যেতে দেখেই ছুট্টে আমার কাছে এসে আমাকে ধরে ফেলল৷ তারপরই..৷’
‘তারপর কী?’
‘তারপর মাম্মির সঙ্গে আমার কী ঝামেলা! মাম্মি আমাকে কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরোতে দেবে না, আর আমি বেরোবই! শেষ পর্যন্ত মাম্মির ধমক খেয়ে…৷’
রাজীব হঠাৎ ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল৷
অচ্যুত ওকে কী বলবে ভেবে পেল না৷ রাজীব কাঁদছে কেন সেটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারল না৷
কান্না থামিয়ে ভাঙা গলায় রাজীব বলল, ‘কাল আমি খুব জোর বেঁচে গেছি, না রে?’
অচ্যুত অবাক হয়ে গেল, ‘কেন বল তো?’
‘আমি গেলাম না বলেই হয়তো ধানকলের মাঠের লোক দুটো খতম হয়ে গেল৷’
‘এসব তুই কী বলছিস!’
‘ঠিকই বলছি৷ স্যারের সেই ডাকের টান যে কী মারাত্মক সে তোকে আমি বলে বোঝাতে পারব না৷’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাজীব ধরা গলায় জানতে চাইল, ‘তোরা শেষ পর্যন্ত আমাকে ধরে রাখতে পারবি তো? তোদের ব্যাগ থেকে আর কখখনও আমি টাকা চুরি করব না…বিশ্বাস কর৷’ রাজীব আবার কাঁদতে শুরু করল৷
ওর কান্নাটা এমন যেন ও জেনে গেছে, ওর কপালে কেউ সুনিশ্চিতভাবে কাটা চিহ্ন এঁকে দিয়েছে৷
অচ্যুতের খুব কষ্ট হল৷ ও বলল, ‘তুই মিছিমিছি কাঁদছিস৷ তোর কোনও ভয় নেই৷ আমি এক্ষুনি কুলদীপ, প্রতীকদের ফোন করছি৷ আধঘণ্টার মধ্যে আমরা তোর বাড়িতে যাচ্ছি৷ আন্টিকে আমাদের জন্যে শরবত তৈরি করে রাখতে বল…৷’
ফোন ছেড়ে দিল অচ্যুত৷
ওর শরীরটা কেমন অবশ লাগছিল৷ দিশেহারাভাবে ও যে-কোনও একটা পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল৷
.
৷৷সাত৷৷
সোমবার সন্ধে সাতটার সময় সৌরভ পরেশদার কেকের দোকানের সামনে এল৷
অচ্যুত আগে থেকে সাইকেল নিয়ে কেকের দোকানের পাশে একটা সাইকেল সারানোর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সৌরভকে দেখেই ওর দিকে এগিয়ে গেল৷ চাপা গলায় জিগ্যেস করল, ‘ক্যামেরা এনেছিস তো?’
সৌরভ মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল৷
‘চল যেতে-যেতে প্ল্যানটা বলছি…৷’
সাইকেলে উঠে পড়ল অচ্যুত৷ সৌরভও সাইকেল নিয়ে ওর পাশে-পাশে চলল৷
সরু রাস্তায় ওদের বেশ কসরত করে সাইকেল চালাতে হচ্ছিল৷ আজ সারাদিনে এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি, তাই রাস্তা মোটামুটি শুকনো৷ তবে বাতাস থমকে গিয়ে একটা গুমোট গরম চেপে বসেছে৷
রাস্তায় মোটামুটি ভিড়৷ তারই মধ্যে দুটো সাইকেল-ভ্যান মাইক লাগিয়ে আগামী রবিবারে কী একটা মিটিং হবে বলে প্রচার চালাচ্ছে৷ ‘দলে-দলে যোগ দিন’ কথাটা বারবার ওদের কানে এসে ঝাপটা মারছিল৷
কোনওরকম যানজট কাটিয়ে সাইকেল-ভ্যানে দুটোকে পেরিয়ে গেল ওরা৷ তারপর জোরে প্যাডেল করতে শুরু করল৷
কাল বিকেলে অচ্যুত, প্রতীক, কুলদীপ আর বাসব রাজীবের বাড়িতে গিয়েছিল৷ ওকে যতটা সম্ভব ভরসা দিয়ে এসেছে৷ কিন্তু অচ্যুত বুঝতে পারছিল, একটা সাংঘাতিক ভয় রাজীবের মনে গেঁথে গেছে৷ ওর কাছে ঘণ্টাদেড়েক থেকে তারপর অচ্যুতরা যার-যার বাড়ি ফিরে গেছে৷
সাইকেল চালাতে-চালাতে সৌরভ আর অচ্যুত স্কুলের কাছে চলে এল৷ স্কুল পেরিয়ে, পুকুর পেরিয়ে, যতই এগোতে লাগল রাস্তার লোকজন ততই ফিকে হতে লাগল৷ সেই সঙ্গে আলোও৷
বর্ষার টইটম্বুর নালা থেকে ব্যাঙের দল ডাকছিল৷ তার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে ঝিঁঝির দল সঙ্গত করছিল৷ বড়-বড় গাছের মাথা আকাশের মেঘের সঙ্গে কখন যে মিশে গেছে সেটা ঠাহর করা যাচ্ছিল না৷ পথের এখানে-ওখানে কয়েকটা ঝুপড়ি-দোকানে পান-বিড়ি-সিগারেট আর চা বিক্রি হচ্ছে৷ তার টিমটিমে আলো দোকান ছাড়িয়ে রাস্তায় পৌঁছতে পারছে না৷
একটু পরেই সত্যবানস্যারের কোচিং-এ পৌঁছে গেল ওরা৷
দেড়খানা ঘর নিয়ে পলেস্তারা-খসা একটা একতলা বাড়ি৷ তার একপাশে টিনের চাল৷ বাড়ির ডানপাশে আর পিছনদিকে গাছ-আগাছার দল যেমন খুশি বেড়ে উঠেছে৷ আর বাঁ-দিকে একটা জং-ধরা ঘাড় কাত করা টিউবওয়েল৷