অচ্যুত ধীরে-ধীরে বলল, ‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও ব্যাপারটা বোধহয় মিথ্যে নয়৷ তা ছাড়া পিশাচের আবার যুগ আছে নাকি!’
কুলদীপ বলল, ‘আমি ওসব ভূত-টুতে বিশ্বাস করি না৷ রাজীব, তোর মনে হয় ভুল হয়েছে৷ তোকে সত্যি-সত্যিই কোনও পোকা-টোকা কামড়েছে৷’
রাজীব চোখ বড় করে জানতে চাইল, ‘তা হলে ওই সবুজ চোখ দুটোও ভুল?’
‘না, মোটেই ভুল নয়,’ জবাব দিল অচ্যুত, ‘আমিও ওই সবুজ চোখ দেখেছি৷ স্যারের মধ্যে যে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে সেটা আঁচ করেছিলাম৷ কিন্তু সেটা যে এইরকম তা বুঝতে পারিনি৷ রাজীব, তুই এখন যা—শুয়ে পড় গিয়ে৷ কয়েকটা দিন রাস্তায় বেরোস না৷ আমরা একটু ভেবে দেখি, কী করা যায়৷ তোর ফোন নাম্বারটা আমাকে দে—৷’
রাজীব ফোন নম্বর বলল৷ অচ্যুত সেটা কয়েকবার বিড়বিড় করে আওড়ে মুখস্থ করে নিল৷
এমন সময় রাজীবের মাম্মি ঘরে ঢুকলেন৷ রাজীবকে লক্ষ করে বললেন, ‘রাজু, চলো, অনেকক্ষণ গল্প হয়েছে৷ এবারে ওষুধ লাগিয়ে রেস্ট নেবে৷ কাল ডক্টর ব্যানার্জি আবার চেক আপে আসবেন৷ তোমরা শরবত খেয়েছ তো?’
শেষ প্রশ্নটা অচ্যুতদের লক্ষ করে৷
প্রতীক আর অচ্যুত গ্লাসের বাকি শরবত শেষ করে উঠে দাঁড়াল৷
কুলদীপ হাঁ করে টিভিতে বাঘ আর বাইসনের লড়াই দেখছিল, অচ্যুত ওকে খোঁচা মারল৷ কুলদীপ ফিরে তাকাতেই ওকে উঠতে ইশারা করল৷
‘আসি, আন্টি৷’
রাজীবকে ‘টা-টা’ করে ওরা তিনজন দরজার দিকে এগোল৷ হঠাৎই প্রতীক ঘুরে দাঁড়িয়ে রাজীবকে বলল, ‘কাল তোকে ফোন করব—৷’ তারপর মাম্মিকে আড়াল করে এক চোখ টিপে হাতের ইশারায় বলতে চাইল, ‘কোনও ভয় নেই৷’
রাস্তায় বেরোতেই কুলদীপ অচ্যুতকে বলল, ‘কী রে, স্যাটাস্যাটের সবুজ চোখের ব্যাপারটা আমাদের বলিসনি তো!’
‘ভয়ে বলিনি৷ আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম৷’
প্রতীক বলল, ‘স্যাটাস্যাট হেভি ডেঞ্জারাস৷ কিন্তু কী করে হঠাৎ এরকম চেঞ্জ হয়ে গেল বল তো?’
‘হয়তো ওর ওপরে পিশাচ ভর করেছে৷’ অচ্যুত বলল, ‘রক্তপিশাচ ড্রাকুলা যেমন ভর করত—আমি টিভিতে দেখেছি৷’
প্রতীক কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘বানজারার গোরু-বাছুরকেও কি তা হলে পোকা কামড়েছে?’
কুলদীপ আর প্রতীকের দিকে তাকাল অচ্যুত৷ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘হ্যাঁ, স্যাটাস্যাট-পোকা৷’
ওর কথায় কেউ হাসল না৷
আর সঙ্গে-সঙ্গেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল৷
ওরা তিনজন যে-যার সাইকেলে উঠে রওনা হয়ে পড়ল৷ যেতে-যেতে কুলদীপ চেঁচিয়ে বলে গেল, ‘কাল স্কুলে দেখা হবে—৷’
রাস্তার দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার আরও বেড়ে গেছে৷ সাইকেল রিকশা, স্কুটার, বা লোকজন চোখে পড়ে কি পড়ে না৷ অচ্যুত সাইকেল চালাচ্ছিল বটে, কিন্তু ওর মন রাস্তার দিকে ছিল না৷ দুটো ধকধকে ক্ষুধার্ত সবুজ চোখ ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল৷
ও মনে-মনে ঘটনাগুলো যতই চিন্তা করছিল ততই যেন সব জট পাকিয়ে যাচ্ছিল৷
পুলিশে খবর দেওয়ার কোনও মানে হয় না, কারণ, কেউ ওদের কথা বিশ্বাস করবে না৷
তা হলে কী করা যায়? সত্যবানস্যারকে ওরা দশ-পনেরোজন মিলে ঘিরে ধরে কোণঠাসা করবে? জবাবদিহি চাইবে? নাকি হেডস্যারের কাছে দলবেঁধে গিয়ে সত্যবানস্যারের নামে নালিশ করবে?
তখনই অমিয়স্যারের কথা মনে পড়ল৷
প্রমাণ চাই, প্রমাণ৷ স্যাটাস্যাটকে লাল হাতে ধরতে হবে৷ কিন্তু সেই সুযোগ কি কখনও পাওয়া যাবে?
এইসব এলোমেলো চিন্তা করতে-করতে অচ্যুত যখন বাড়ি ফিরল তখন দেখল মা একরাশ দুশ্চিন্তা মুখে নিয়ে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে৷
একইসঙ্গে ও চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল, মউলিদের বাড়ির দোতলার বারান্দায় সেই মেয়েলি ছায়াটা এখনও একইরকমভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে৷
মা বলল, ‘সেই কখন থেকে তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি! একে রাত হয়েছে, তার ওপর বৃষ্টি—একটা বিপদ হলে তখন কী হবে বল তো!’
অচ্যুত সামান্য হাসল৷ সাইকেলটা হাঁটিয়ে নিয়ে মা-কে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল৷ মা-কে ও বলতে পারল না, ‘বিপদ হলে তখন কী হবে’ নয়—এর মধ্যেই ও বিপদের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে৷ অভিমন্যুর মতো ওকে চক্রব্যূহ ভেদ করার চেষ্টা করতে হবে৷ যদি ভেদ করতে না পারে, তা হলে অভিমন্যুর মতোই হয়তো ওর…৷
অচ্যুত আর ভাবতে পারল না৷
রাজীবের ঘটনাটা ওর শিরদাঁড়ায় বরফ জমিয়ে দিয়েছে৷
.
৷৷ছয়৷৷
পরদিন স্কুলে গিয়ে অচ্যুতরা জোট পাকাতে শুরু করল৷
ও, কুলদীপ, প্রতীক, বাসব, সৌরভ সবাই বন্ধুদের রাজি করিয়ে কাছাকাছি ডেস্কে বসল৷ আর ক্লাসের মাঝে ফাঁক পেলেই ফিসফাস করে আলোচনা করতে লাগল৷
একটার পর একটা ক্লাস হয়ে যাচ্ছে, ওদের সেদিকে মন নেই৷ আনমনা হওয়ার জন্য বাসব ভূগোলের পিরিয়ডে কালীপদস্যারের কাছে বকুনিও খেল৷ কিন্তু সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা এত সাঙ্ঘাতিক যে, ওরা কেউই পড়াশোনায় মন দিতে পারছিল না৷
টিফিনের ঘণ্টা যখন পড়ল তখনও ওরা ক্লাসে বসে রইল৷ যে দু-তিনজন ঘরে বসেই টিফিন খায়, কুলদীপ তাদের মাঠে যেতে বলল, ‘তোরা নীচে গিয়ে টিফিন খা৷ আমাদের একটু প্রাইভেট কথা আছে৷’
কুলদীপকে সবাই একটু সমীহ করে৷ তাই কেউই কথা বাড়াল না৷
অচ্যুতের কাছে সব শোনার পর বাসব আর সৌরভ তো একেবারে থ হয়ে গেল৷
প্রতীক বলল, ‘সেইজন্যেই তুই আর কুলদীপ অত গুজগুজ করতিস!’