‘সত্যবানস্যারের সঙ্গে সাইকেল ছিল৷ বললেন, আমার সঙ্গে কী কথা আছে…যেতে-যেতে বলবেন৷ আমি কেক-টেক কিনে ওঁর সাইকেলে উঠলাম—সামনে রডের ওপরে বসলাম৷ স্যারের চোখে-মুখে একটা চাপা ফুর্তি টের পাচ্ছিলাম৷ কিন্তু কেন সেটা বুঝতে পারিনি৷
‘…সাইকেল চালিয়ে যেতে-যেতে স্যাটাস্যাট অঙ্ক নিয়ে খুব জ্ঞান দিতে লাগল৷’ অচ্যুতের দিকে ইশারা করে রাজীব বলল, ‘তোর অঙ্কের মাথা নিয়ে খুব প্রেইজ করছিল৷ আর কথা বলতে-বলতে…৷’ রাজীবের চোখ সরু হয়ে এল : ‘আমার ঘাড়ের কাছে বারবার ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছিল৷ আমার বিরক্ত লাগছিল…কিন্তু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে যেন পড়ে গিয়েছিলাম৷ স্যাটাস্যাটের জড়ানো গলায় কথা শুনতে-শুনতে আমার ঝিম ধরানো নেশা মতন হয়ে গেল৷ ততক্ষণে সাইকেল ঘোষদের বাগানবাড়ি ছাড়িয়ে পুকুরের পাশের অন্ধকার রাস্তায় চলে এসেছে৷ আমি বললাম, ‘‘স্যার, এ-রাস্তা দিয়ে এলেন কেন?’’ আমার মাথার পেছন থেকে স্যাটাস্যাট খিলখিল করে হাসল৷ তারপর বলল, ‘‘এটাই তো তোর বাড়ি যাওয়ার শর্টকাট রে বোকা!’’
‘আমি কিন্তু জানতাম যে, ওটা শর্টকাট নয়—তবুও কিছু বলতে পারলাম না৷ কেমন যেন হিপনোটাইজড হয়ে গিয়েছিলাম৷ নিজের ওপরে আর কোনও কন্ট্রোল ছিল না৷
‘স্যাটাস্যাট একটা বটগাছের তলায় ঝুপসি অন্ধকারে সাইকেলটা দাঁড় করাল৷ বটগাছের ঝুরির ফাঁক দিয়ে ঘোলাটে চাঁদ দেখা যাচ্ছিল৷ চারপাশে কেউ কোথাও নেই৷ পুকুরের দিক থেকে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছিল৷
‘আমার বেশ ভয় করছিল, কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছিলাম না৷ গলার ভেতরে কেউ যেন খানিকটা তুলো গুঁজে দিয়েছে৷ এমন সময় পুকুরের কালো জলে কোনও মাছ বোধহয় ঘাই মারল—ছপাৎ করে শব্দ হল৷ আর সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড়ে কাঁটা ফোটার মতো ব্যথা পেলাম৷ তারপরই জায়গাটা চিনচিন করতে লাগল৷ আমি…৷’
ডিসকভারি চ্যানেলে আচমকা বাঘের গর্জন শোনা গেল৷ ওরা চারজনেই সামান্য চমকে উঠল৷ এই গরমের মধ্যেও অচ্যুতের কেমন যেন শীত করছিল৷
ওরা টিভির দিকে তাকিয়েছিল৷ তখনই দেখল, একজন মহিলা একগ্লাস শরবত নিয়ে ঘরে ঢুকছেন৷
শরবতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে তিনি চলে গেলেন৷ রাজীব গ্লাসটা তুলে নিয়ে অচ্যুতের হাতে দিল, ‘নে, শরবত খা৷’
অচ্যুত এক ঢোঁকে শরবতের গ্লাস অর্ধেকটা শেষ করে জানতে চাইল, ‘তারপর?’
রাজীব দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল :
‘…আমি অসাড় হয়ে সাইকেলের রডের ওপরে বসে রইলাম৷ নড়াচড়ার শক্তি নেই৷ স্যারও কোনও কথা বলছিলেন না৷ একটা ঘোরের মধ্যে সময় কেটে যেতে লাগল৷ চোখের সামনে থেকে চাঁদ মুছে গেল৷ ব্যাঙের ডাক আর শুনতে পাচ্ছিলাম না৷ শুধু চিনচিনে ব্যাপারটা টের পাচ্ছিলাম৷
‘…ওইভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না৷ একসময় আবার চাঁদ দেখতে পেলাম, ব্যাঙের ডাকও শুনতে পেলাম৷ শরীরটা খুব উইক লাগছিল৷ ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল৷ টের পেলাম, স্যার আমার ঘাড়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷ জামার কলারটা তুলে দিয়ে ঘাড়ের কাছটা ভালো করে ঢেকে দিতে চাইলেন৷ তারপর বললেন, ‘‘আমার দিকে একবার তাকা…৷’’ আমি অন্ধ ভক্তের মতো ওঁর হুকুম মেনে তাকালাম…৷’
রাজীব হঠাৎই শিউরে উঠল৷ পাশে বসে থাকা অচ্যুতের হাত খপ করে চেপে ধরল৷ কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘বাড়িতে এসব কথা একদম বলিনি৷ তোদের বলছি—৷’
‘তাকিয়ে কী দেখলি?’ প্রতীক জিগ্যেস করল৷
‘দেখলাম…৷’ চোখ গোল-গোল করে তাকাল রাজীব৷ ওর মুখ আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল : ‘দেখলাম, স্যারের চোখ দুটো গাঢ় সবুজ—ধকধক করে জ্বলছে—আর তার মধ্যে দুটো কালো ফুটকি৷ ঠিক যেন বেড়াল বা চিতাবাঘের চোখ৷ চোখ তো নয়, মার্বেল পাথর বসানো! স্যার অদ্ভুতভাবে হেসে ভয়ানক গলায় বললেন, ‘‘কাউকে এসব বলবি না৷ তুই এখন আমার! আমার কথায় উঠবি, আমার কথায় বসবি, আমার কথায় চলবি৷ আমার ইশারা তোর কাছে আদেশ৷ এ-কথা মনে রাখিস৷’’
‘আশ্চর্য! বিশ্বাস কর, স্যারের ওপরে আমার একটুও রাগ হল না৷ ছুটে পালাতেও ইচ্ছে করল না৷ পাথরের স্ট্যাচুর মতো স্যারকে দেখছিলাম, স্যারের কথা শুনছিলাম৷
‘এরপর স্যার সাইকেল চালিয়ে আমাকে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিলেন৷ কানের কাছে মুখ এনে সাপ-খেলানো সুরে অনেক কথা বললেন৷ কথাগুলো সব আমার মনে নেই৷ তবে একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে আমি বাড়ি এলাম৷ গলার পাশে, ঘাড়ের কাছটায় চুলকোচ্ছিল৷ হাত দিতেই কেমন চটচটে লাগল৷ দেখি রক্ত৷ তখনই আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেছি৷ তারপর বাপি-মাম্মির হইচই, ডাক্তার ডাকাডাকি, কত কী কাণ্ড!
‘বাড়িতে আমি ভয়ে কোনও কথা বলিনি৷ বলেছি, অন্ধকারে ওই পুকুরের কাছটায় কী একটা পোকা যেন কামড়ে দিয়েছে৷ কিন্তু তোদের সত্যি কথা বলছি, সত্যবানস্যারের ভয়ে আমি একেবারে কাঁটা হয়ে আছি৷ বারবার মনে হচ্ছে, কাল রাতের ব্যাপারটা পুরোপুরি স্বপ্ন—একবর্ণও সত্যি নয়৷ কিন্তু আসলে তো সত্যি! এখন তোরা আমাকে বাঁচা৷ কী করব বলে দে—৷’
রাজীবের কথা শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে রইল৷ কুলদীপ ওর কদমছাঁট চুলে হাত বোলাতে-বোলাতে টিভির দিকে তাকিয়ে রইল৷ প্রতীক বয়স্ক মানুষের মতো ভুরু কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে বসে৷ আর অচ্যুতের মনের ভেতরে তোলপাড় চলছিল৷
কী করা উচিত এখন?
প্রতীক বিড়বিড় করে বলল, ‘স্যাটাস্যাট আসলে ড্রাকুলা! আজকের যুগে এ তো বিশ্বাস করা মুশকিল!’