প্রিয়াংকা বলতে শুরু করল৷ ও মনে-মনে সেই ভয়ংকর ভোরবেলায় ফিরে গেল৷ সেদিনকার প্রতিটি দৃশ্য প্রতিটি ঘটনা ওর মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে৷ সুতরাং ওর বর্ণনায় কোনও ফাঁক ছিল না৷
শেষে ও বলল, কীভাবে ওর মুখ দিয়ে একটা চাপা শব্দ বেরিয়ে এসেছিল৷ তাতেই ওই ভয়ংকর লোকদুটো ওকে দেখতে পায়, ওর দিকে ছুটে আসে৷ তখন ও ছুটে পালায়৷
ওর কথার মাঝে-মাঝে মিস্টার প্রধান কথা বলছিলেন, নানান প্রশ্ন করছিলেন৷ তাতে টেনশন কেটে গিয়ে স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পাচ্ছিল প্রিয়াংকা৷ প্রধানকে ওর ডিসি ডিডি ওয়ান নয়, অভিভাবক বলে মনে হচ্ছিল৷
প্রধান বললেন, ‘সেদিন তুমি খুব জোর বেঁচে গেছ৷ আর-একটু হলেই লোকগুলো—৷’
‘হ্যাঁ, আমি বাপিকে বলছিলাম৷ যদি অন্য ড্রেস পরে থাকতাম…৷’
‘ভাগ্যিস তুমি সেদিন জিনস পরেছিলে! নইলে অত জোরে ছুটতে পারতে না৷’
সুন্দরলাল প্রধান হেসে এই কথা বলামাত্রই বুলেটের মতো ছিটকে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রিয়াংকা৷ চোখ গোল-গোল করে প্রধানকে দেখতে-দেখতে পিছিয়ে গেল৷ শেষ পর্যন্ত ঘরের দেওয়ালে পিঠ ঠেকতেই দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ও বড়-বড় শ্বাস ফেলছিল৷
প্রধানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বিস্ময়ে হোঁচট খেয়ে ও বলল, ‘আ—আপনি কী করে জানলেন আমি জিনস পরেছিলাম? ক্যাসেটে তো আমার কোনও ছবি নেই! আর—আর একবারও তো সে-কথা আমি বলিনি! কী করে জানলেন আপনি?’
প্রধানের মুখের রক্ত পলকে শুষে নিয়েছিল কেউ৷ বুঝতে পারছিলেন, বেখেয়ালে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন৷ তির ছুটে বেরিয়ে গেছে হাত থেকে৷ আর ফেরানোর কোনও উপায় নেই৷
কথা বলতে গিয়ে ওঁর কথা আটকে যাচ্ছিল৷ হাত তুলে প্রিয়াংকাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে কোনওরকমে বললেন, ‘প্লিজ, প্রিয়াংকা, প্লিজ৷ কিপ ইয়োর কুল৷ ডোন্ট গেট মি রং৷ আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি…লক্ষ্মী মেয়ে…৷’
প্রিয়াংকা কোণঠাসা বেড়ালের মতো আক্রমণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিল৷ প্রধানের শেষ কথাটা ওর শরীরে বিদ্যুৎ-তরঙ্গ ছড়িয়ে দিল৷ ঠিক এইরকম ভঙ্গিতেই না কথা বলেছিল সেই ‘বস’!
প্রিয়াংকা পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি! তুমি! তুমি!’
এবার সুন্দরলাল ওঁর ভদ্রতার পোশাকটা ঝেড়ে ফেললেন৷ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চট করে পকেট থেকে একটা কালো রঙের রিভলভার বের করে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি৷ সিনেমার ওই টাকমাথা লোকটা আমি৷ ওই টাক আর গোঁফ হল ডিসগাইজ—ছদ্মবেশ৷’ তারপর মিহি এবং মোলায়েম গলায় স্নেহ-মাখানো সুরে বলতে শুরু করলেন, ‘কী অসম্ভব বুদ্ধিমতী মেয়ে! যেমন রূপ তেমনই গুণ৷ রূপে-গুণে একেবারে নজিরবিহীন মাখামাখি৷ বড়ই তৃপ্তিদায়ক—এবং বেদনাগম্ভীর৷ তোমাকে নিয়ে এখন কী করি বলো তো? এই অফিসে তো আর হত্যাকাণ্ড ঘটানো যায় না…তবে তার কাছাকাছি কিছু করা যায়৷ এই ধরো ক্ষুদ্র একটি ইনজেকশান প্রয়োগ করে তোমাকে ঘুম পাড়ানো যায়৷ তাতে তোমার জ্ঞান ফিরবে কমপক্ষে চবিবশ ঘণ্টা পর৷ ততক্ষণে তোমার ‘‘বাপি’’ আর সোনম পগার পার— সোজা আকাশে…৷’
প্রিয়াংকা বারবার ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকাচ্ছিল৷ আশা করছিল ওর চিৎকার শুনে কেউ-না-কেউ ঘরে আসবে৷
সেটা লক্ষ করে প্রধান ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন৷ গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললেন, ‘কেউ আসবে না৷ অর্ডার আছে, কেউ আমাদের ডিসটার্ব করবে না৷ তাই বলছি, মুখ বুজে থাকো৷ তোমাকে তার জন্যে পুরস্কার দেব—প্রচুর টাকা…৷’
প্রিয়াংকা ভয় পাচ্ছিল৷ কিন্তু একইসঙ্গে একটা ভয়ংকর জেদ ওর মধ্যে কাজ করছিল৷ ও শব্দ করে ঘেন্নার থুতু ফেলল মেঝেতে৷ হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘তোমার টাকা তোমার থাক৷ আমার চাই না৷ আর আমার যদি এখানে কিছু হয় তা হলে ওই সিডির ছবি এম এম এস করে ছড়িয়ে যাবে ইন্টারনেটে আরও হাজার-হাজার লোকের মোবাইলে৷ তোমার ফটোটা এনলার্জ করলেই ওই নকল টাক ধরা পড়বে৷ আর বাকি শাগরেদগুলোর কাছ থেকেও প্রচুর ইনফরমেশান পাওয়া যাবে৷ তুমি কিছুতেই বাঁচবে না—৷’
পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করল প্রিয়াংকা৷ বোতাম টিপে কল করল মিমোকে৷
প্রধানের চোখেমুখে দ্বিধার ছাপ ফুটে উঠেছিল৷ তিনি ভাবছিলেন, মেয়েটা হয়তো ব্লাফ দিচ্ছে৷
প্রিয়াংকা সেটা আন্দাজ করতে পারল কি না কে জানে৷ ও মোবাইল ফোনের লাউডস্পিকার অন করে দিল৷ তারপর বলল, ‘মিমো, এম এম এস-এর কথাগুলো বলো…৷’
মিমোর সঙ্গে আগে থেকে কথা বলাই ছিল৷ মিমো গড়গড় করে বলে গেল কীভাবে সিডির ছবি আমজনতার কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে৷ কীভাবে ওরা প্রচারে-প্রচারে ছেয়ে দেবে গোটা কলকাতা৷ কীভাবে ওরা সব ব্যবস্থা নিয়েছে৷
প্রিয়াংকা প্রধানকে বলল, ‘শুনলে তো! আমি বারবার বলেছি, এই ক্যাসেটটা আমার বেঁচে থাকার লাইসেন্স৷ ওটা কখনও আমি কপি না রেখে হাতছাড়া করতে পারি!’
এবার সুন্দরলালের চোয়াল ঝুলে পড়ল৷ ঘরে এসি চলা সত্ত্বেও ওঁর কপালে ঘামের ফোঁটা৷
প্রিয়াংকা মোবাইল ফোন পকেটে রেখে বলল, ‘তোমার সব খেলা শেষ৷ চোরাই হিরে, খুন…খোঁজ করলে আরও কত কী বেরোবে৷ এখন কেঁচোর গর্ত খুঁড়ে সাপ বের করার সময়…৷’ ঘরের দরজার কাছে এগিয়ে গেল প্রিয়াংকা৷ শব্দ করে ছিটকিনি খুলে দরজাটা হাট করে খুলে দিল৷ সবাই আসুক—এসে সাপটাকে দেখুক৷