নির্দেশ যিনি দেবেন তিনি বাঁ-দিকের দেওয়াল ঘেঁষে একটা সোফায় বসে আছেন৷ ডিসি ডিডি ওয়ান সুন্দরলাল প্রধান৷ ফরসা মাঝারি চেহারা৷ মাথায় ছোট করে ছাঁটা কাঁচাপাকা চুল৷ পরিষ্কার করে গোঁফ-দাড়ি কামানো৷ চোখে ছোট লেন্সের চশমা৷
‘সিনেমা’-র দর্শকদের জন্য তিনটে লম্বা-লম্বা সোফা সমান্তরাল-ভাবে পাতা রয়েছে৷ তার প্রথম সারিতে বসেছেন অনুজ দাশগুপ্ত, ডানপাশে প্রিয়াংকা৷
প্রিয়াংকাকে দেখেই বোঝা যায় ও বেশ টেনসড হয়ে রয়েছে৷ মুখে কোনও কথা নেই৷ ‘সিনেমা’ কখন শুরু হবে সেজন্য অপেক্ষা করছে৷
অনুজ দাশগুপ্তর বাঁ-পাশে বসে আছেন আর-এক পুলিশকর্তা চঞ্চল সরকার৷ মিস্টার প্রধানের তুলনায় বেশ রোগা৷ গায়ের রং মাঝারি৷ কপালের দুপাশে চুল কমে এসেছে৷ বয়েস অবশ্যই পঞ্চাশ পেরিয়েছে৷ চোখে কার্বন ফ্রেমের চশমা৷ মুখে একটা নির্বিকার উদাসীন ভাব৷
এই পাঁচজন ছাড়া ঘরে আর কোনও লোক নেই৷ মিস্টার প্রধানের নির্দেশে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷
প্রিয়াংকা ওর মাইক্রো-ক্যাসেটটা সত্যিই এক অদ্ভুত জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিল৷ ওটা একটা পলিথিন প্যাকেটে মুড়ে ওর কলেজের ক্যাম্পাসের বাইরে একটা শিমুল গাছের কোটরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ও৷ গতকাল বিকেলে লালবাজার থেকে তিনজন অফিসার আর মানিকতলা থানার অনুজ দাশগুপ্ত প্রিয়াংকা আর ওর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে প্রিয়াংকার কলেজের কাছে গেছেন৷ ক্যাসেটটা উদ্ধার করে লালবাজারে ডিসি ডিডির কাছে জমা দিয়েছেন৷ আজ তিনি প্রিয়াংকাকে ডেকেছেন সে-ব্যাপারে কথা বলার জন্য৷ ওর বাবাও সঙ্গে এসেছেন, কিন্তু ওঁকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে৷
মিস্টার প্রধান এবার কথা বললেন, ‘যা আমরা দেখতে চলেছি, শুনতে চলেছি—সবই হাইলি কনফিডেনশিয়াল৷ এ-ঘরের একটি কথাও যেন বাইরে না যায়৷ দিস ইজ মাই অর্ডার৷ কী বলেন, মিস্টার সরকার?’
শেষ প্রশ্নটা চঞ্চল সরকারকে লক্ষ করে৷
তিনি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘একদম ঠিক বলেছেন৷ এই মাইক্রো-ক্যাসেটটা নিয়েই এত গণ্ডগোল৷ নিশ্চয়ই এর মধ্যে এক্সপ্লোসিভ কোনও মেটিরিয়াল আছে৷ ব্যাপারটা দেখার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব—তার আগে নয়৷’
মিস্টার প্রধান বললেন, ‘কাল ক্যাসেটটা হাতে পাওয়ার পর আমি ওটা একটা সিডিতে রাইট করিয়ে নিয়েছি৷ এখন সেই সিডিটাই সুশান্ত চালাবে৷’ এবার কম্পিউটারের পাশে চেয়ারে বসা ছেলেটির দিকে তাকালেন মিস্টার প্রধান : ‘সুশান্ত, স্টার্ট—৷’
কম্পিউটার চালু হল৷ পরদায় আলোছায়া দিয়ে ছবি তৈরি হল৷
কিন্তু এ কী! এ কী দেখছে প্রিয়াংকা? কোথায় সেই ভোরবেলার ময়দানে নৃশংস খুনের ছবি? তার বদলে নানান রঙের রঙিন ফুল৷ কোনও ফুলের প্রদর্শনীতে গিয়ে কেউ যেন হাসিখুশি ফুলের সুন্দর-সুন্দর ছবি তুলেছে৷
প্রিয়াংকা উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ স্থান-কাল-পাত্র ভুলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এসব কী ব্যাপার, স্যার? আমার ক্যাসেটে তো অন্য ছবি ছিল— একটা রুথলেস মার্ডারের ছবি৷ সেসব পালটে গেল কেমন করে!’
মিস্টার প্রধান রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়লেন৷ চঞ্চল সরকারের দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘সরকার, দিস ইজ আউটরেজিয়াস! ডিপার্টমেন্টে এসব হচ্ছেটা কী!’ বিরক্তিতে দু-হাত ছুড়ে বলে উঠলেন, ‘এখন কী করে আমরা জানতে পারব ওই ক্যাসেটে কী ছিল? ডিপার্টমেন্টেই আমি তা হলে সিরিয়াস প্রোব চালাব—তাতে সি. এম. যদি আমাকে শো-কজ করেন করবেন৷ আমি কিন্তু ছাড়ব না…৷’
দাশগুপ্ত চুপচাপ বসে সব দেখছিলেন৷ ওঁর সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল৷ একবার পরদার ফুলের ছবির দিকে, একবার সুন্দরলাল প্রধানের দিকে, আর-একবার প্রিয়াংকার দিকে দেখছিলেন৷
প্রিয়াংকার সুন্দর মুখ লালচে দেখাচ্ছিল, ওর কপালে সন্দেহের কয়েকটা ভাঁজ৷
হঠাৎই ও সোফা থেকে ওর সাইডব্যাগটা তুলে নিল৷ ওটার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা সিডি বের করে নিল৷ সেটা হাতে নিয়ে ডিসি ডিডির কাছে এগিয়ে গেল৷
‘স্যার, আমি একটু ভয় পেয়ে গিয়ে অনেকদিন আগেই ওই ক্যাসেটটার একটা ব্যাকআপ সিডি তৈরি করে রেখেছিলাম৷ নিন, এটা চালালেই সব দেখতে পাবেন৷ মনে হয়, আর কোনও প্রবলেম হবে না…৷’
প্রধান বেশ অবাক হয়ে গেলেন৷ সিডিটা নিয়ে হেসে বললেন, ‘স্মার্ট গার্ল৷ তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়৷ আমার মনে হয়, ক্যাসেট থেকে সিডিতে কনভারশনের সময় আমার ডিপার্টমেন্টের লোকেরা কোনও গণ্ডগোল করেছে৷ যদি না তোমার ক্যাসেটটাতেই ওরিজিন্যালি কোনও প্রবলেম থেকে থাকে…৷’
প্রিয়াংকা কোনও উত্তর দিল না৷ ফিরে এসে সোফায় বসল৷
ক্যাসেটটাতে যে কোনও প্রবলেম ছিল না সেটা সিডিটা চালাতেই বোঝা গেল৷
সবাই রুদ্ধশ্বাসে খুনের ‘সিনেমা’ দেখতে লাগলেন৷ এসি মেশিনের ভ্রমর-গুঞ্জন ছাড়া ঘরে আর কোনও শব্দ নেই৷ অনুজ দাশগুপ্ত ভাবতেই পারেননি মাইক্রো-ক্যাসেটে এরকম মারাত্মক কিছু থাকতে পারে৷
মনে-মনে প্রিয়াংকার সাহসের তারিফ করলেন তিনি৷
ছবির কথাবার্তাগুলো ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না৷ তবে ‘…কৌটোর ভেতরে হিরেগুলো আছে…’ এই কথাটা বেশ বোঝা গেল৷
মিস্টার প্রধান সোফায় নড়েচড়ে বসলেন—কিন্তু কোনও কথা বললেন না৷
ছবি দেখানো শেষ হলে তিনি সুশান্তকে বললেন সিডিটা আবার চালাতে৷