লাথিটা মিমোর পেটে এসে লাগল৷ কিন্তু তার আগেই মিমো পেটের মাসল শক্ত করে ফেলেছে৷ ফলে লাথিতে তেমন কাজ হল না৷ মিমোর শরীরটা খানিকটা টলে গেল শুধু৷ ও চট করে লোকটার ডান পায়ের গোড়ালি চেপে ধরল৷ তারপর সেটাকে প্রবল মোচড় দিয়ে নিজের শরীরটাকে পাশে ঝুঁকিয়ে দিল৷
লোকটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল৷ মিমো সেই চিৎকারটা জোরালো করতে লোকটার তলপেটে একটা নিষ্ঠুর লাথি কষিয়ে দিল৷
জিমের বিশ্বজিৎদার কথা মনে পড়ল মিমোর৷ বিশ্বজিৎদা বলে, ‘বডি তৈরি করার সবচেয়ে বড় কারণ হল সেলফ-ডিফেন্স—আত্মরক্ষা৷’ তার মানে, নিজের ডিফেন্স—এবং শত্রুর প্রতি অফেন্স৷ নাঃ, মিমোর কিছু করার নেই৷ সেই সকাল থেকে ও চুপচাপ অনেক কিছু দেখেছে, শুনেছে—কিন্তু কিছু করেনি৷ এখন সেই করার সুযোগ এসেছে৷
সুতরাং, বাঁ-হাতের এক থাবায় লোকটার জামা খামচে ধরল মিমো৷ ওকে টেনে তুলেই ডানহাতের এক ঘুষিতে নাক-মুখ রক্তাক্ত করে দিল৷ লোকটা আত্মরক্ষার চেষ্টায় মিমোর জামা আঁকড়ে ধরেছিল৷ সেই অবস্থায় লোকটা রাস্তায় পড়ে যেতেই মিমোর শার্টটা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে গেল৷
মিমোদের ঘিরে ভিড় জমে গিয়েছিল৷ নানান জল্পনা চলছিল৷ কিন্তু কেউ কিছু করে ওঠার আগেই বাবলি ভিড় ঠেলে ‘মিমো! মিমো!’ বলে ডাকতে-ডাকতে ঢুকে পড়ল৷ তারপর অবস্থা দেখে চেঁচিয়ে বলল, ‘সবাই সরে যান৷ এটা পুলিশ-কেস৷ এই লোকটা ক্রিমিনাল—৷’
একটু আগেই যে গুলির শব্দ হয়েছে সেটা জনতার কেউ-কেউ শুনেছে৷ তাই বাবলির কথায় কাজ হল৷ ভিড়ের বৃত্তটা মাপে একটু বড় হল৷
বাবলি আর মিমো নেতিয়ে পড়া লোকটাকে বলতে গেলে চ্যাংদোলা করে তুলে নিল৷ তারপর পুলিশের গাড়ির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল৷
খানিকটা পথ যেতে না যেতেই অনুজ দাশগুপ্তর সঙ্গে ওদের দেখা৷ তিনি ব্যস্তভাবে বললেন, ‘তোমরা কোথায় গিয়েছিলে? এই লোকটাই বা কে?’
‘ওই বাড়িটা থেকে বেরিয়ে পালাচ্ছিল, স্যার৷’ হাঁপাতে-হাঁপাতে মিমো বলল৷ তারপর এক ঝটকায় লোকটাকে দাঁড় করিয়ে দিল৷
প্রিয়াংকা লোকটাকে দেখে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল৷
অনুজ অবাক হয়ে প্রিয়াংকার দিকে তাকালেন৷ ওঁর চোখে জিজ্ঞাসা৷
প্রিয়াংকা কাঁপা গলায় বলল, ‘এই লোকটা আমাকে চড় মেরেছিল৷’
মিমো সঙ্গে-সঙ্গে লোকটার গালে সপাটে এক চড় কষিয়ে দিল৷ লোকটার মাথা চকিতে পাশে ঘুরে গেল৷
তারপর ছেঁড়া জামাটাকে সাধ্যমতো ঠিকঠাক করে প্রিয়াংকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মিমো বলল, ‘হাই, প্রিয়াংকা৷ আমি মিমো—৷’
‘আমি বাবলি৷’ বাবলিও হেসে হাত বাড়াল প্রিয়াংকার দিকে৷
প্রিয়াংকা মিমোর হাত চেপে ধরে বলল, ‘হাই৷ আমি প্রিয়াংকা৷ মিমো, য়ু আর গ্রেট৷ তুমি হেলপ না করলে আমি হয়তো মরেই যেতাম—৷’
মিমোর হাত ছেড়ে এবার বাবলির হাতে হাত মেলাল প্রিয়াংকা : ‘বাবলি, য়ু অলসো ডিজার্ভ মেনি-মেনি থ্যাংকস৷ আই ও য়ু মাই লাইফ৷’
বাবলি ইংরেজি কথাগুলোর উত্তরে কী বলবে ভেবে পেল না৷
পরিচয়ের প্রথম ধাপ শেষ হতেই অনুজ ওদের তাড়া দিলেন৷ মিমোদের হাত থেকে ক্রিমিনালটাকে নিয়ে মহেন্দ্রকে বললেন লোকটাকে অন্য অফিসারদের কাছে জমা করে দিতে৷ মিমো লক্ষ করল, মহেন্দ্রর বাঁ-হাতে কনুইয়ের ঠিক ওপরে কাপড় জড়িয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা৷
এবার মিমোদের তাড়া লাগালেন অনুজ৷ বললেন, ‘চটপট গাড়িতে চলো৷ পথে যেতে-যেতে কথা বলা যাবে৷’
ওরা সবাই তাড়াতাড়ি পা চালাল গাড়ির দিকে৷
ধনিয়া গাড়ি স্টার্ট দিতেই অনুজ নিজের মোবাইল ফোনটা প্রিয়াংকার দিকে এগিয়ে দিলেন৷ বললেন, ‘এবার তুমি তোমার বাবাকে ফোন করো৷ কথা বলার পর লাইনটা আমাকে দিয়ো…৷’
গাড়ির দ্বিতীয় সিটে বাবলি আর মহেন্দ্রর মাঝে প্রিয়াংকা বসেছিল৷ এখন ও অনেক স্বাভাবিক হয়েছে৷ একটু আগেও ওর চোখে-মুখে যে-ভয়ের কাঠ-কাঠ ভাবটা ছিল এখন সেটা আর নেই৷ ওকে এখন বেশ কোমল আর সুন্দর দেখাচ্ছে৷
বাবাকে লাইনে পাওয়ার পর কথা বলতে গিয়ে ও ‘বাপি! বাপি!’ বলে আবেগে কেঁদে ফেলল৷ আনন্দ আর খুশিতে ওর দু-চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল৷
বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর সোনম লাইনে এল৷ প্রিয়াংকা ভাইয়ের সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলল৷
কিছুক্ষণ পর কথা বলা শেষ করে অনুজ দাশগুপ্তকে ফোনটা ফিরিয়ে দিল প্রিয়াংকা৷
অনুজ মিস্টার মজুমদারকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘…দেখুন, মিস্টার মজুমদার, থানায় গিয়ে আমাদের কিছু ফরমালিটি—মানে, পেপারওয়ার্ক—বাকি আছে৷ তারপরই প্রিয়াংকাকে আমি নিজে গিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব৷ আপনি কোনও চিন্তা করবেন না৷ মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আমার এই নম্বরটায় যখন খুশি ফোন করবেন৷…ও. কে.৷’
ফোন ছাড়তে না ছাড়তেই অনুজের মোবাইল ফোন বেজে উঠল৷ ফোনে ‘হ্যালো’ বলার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অনুজ নড়েচড়ে তটস্থ হয়ে বসলেন৷ ডিসি ডিডি ওয়ান নিজে ফোন করেছেন৷
‘হ্যাঁ, স্যার—বলুন৷ আমি অনুজ দাশগুপ্ত৷ মানিকতলা থানার অ্যাডিশন্যাল ও. সি.—৷’
‘হ্যাঁ, জানি৷’ ওপাশ থেকে গম্ভীর গলা ভেসে এল : ‘আপনার কথা শুনেছি৷ আপনি তো আগে কাশীপুর থানায় ছিলেন—৷’
‘হ্যাঁ স্যার৷’
‘মেয়েটাকে রেসকিউ করার জন্যে কনগ্র্যাচুলেশানস৷’
‘থ্যাংক য়ু, স্যার৷’
‘মেয়েটাকে নিয়ে এক্ষুনি আমাদের ডিপার্টমেন্টে চলে আসুন৷ ওর স্টেটমেন্ট নেওয়ার সময় আমি থাকতে চাই৷ আর ওই মাইক্রো-ক্যাসেট…৷’