ভুরু উঁচিয়ে লোকটা বলল, ‘নেই?’ তারপর চাপা গলায় হেসে উঠল৷ প্রিয়াংকার নরম গলায় রিভলভারের নলটা আরও জোরে ঠেসে দিয়ে বলল, ‘তা হলে আমাকে অ্যারেস্ট করুন, স্যার৷’ বাঁ-হাতের আঙুল নেড়ে অনুজকে ইশারা করে ডাকল শত্রু : ‘আয়—আয়, আমাকে অ্যারেস্ট করবি আয়…৷’
বাড়িটার অন্যান্য অংশ থেকে নানান তীব্রতার শব্দ ছিটে আসছিল৷ তার সঙ্গে মিশে ছিল ‘অপারেশান ব্ল্যাক’-এর অফিসারদের কথাবার্তার টুকরো৷ ওঁরা এই গোডাউনটার দিকে আসছেন না কেন? মহেন্দ্ররই বা কী হল?
এমন সময় মহেন্দ্র শর্মা ছুটতে-ছুটতে গোডাউনের দরজায় এসে হাজির হলেন৷ পরিশ্রমে বেশ হাঁপাচ্ছেন৷ ওঁর বাঁ-হাতের কনুইয়ের কাছটা লাল হয়ে আছে—বোধহয় গুলিতে চোট পেয়েছেন৷ ডানহাতে রিভলভার৷
ঘরের দৃশ্যটা দেখেই মহেন্দ্র থমকে গেলেন৷ অনুজকে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল৷ একলহমা চোখ বুলিয়েই পরিস্থিতি আঁচ করে নিলেন৷
একটু সময় নিয়ে তারপর অনুজকে মহেন্দ্র জিগ্যেস করলেন, ‘স্যার, ইয়ে লড়কি…প্রিয়াংকা মজুমদার?’
অনুজ মাথা নেড়ে বোঝালেন, হ্যাঁ৷
এই আহত অবস্থাতেও মহেন্দ্র হাঁপাতে-হাঁপাতে অনুজের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন : ‘তা হলে, স্যার, দু-চোখের মাঝখানে…৷’
এবং মহেন্দ্র গুলি করলেন৷ বদ্ধ ঘরে বিকট শব্দ হল৷
ঠিক দু-চোখের মাঝখানে নয়—একটু ওপরে গুলিটা লাগল৷ লোকটার কপালে একটা কালো টিপ তৈরি হয়ে গেল৷ চোখের পলকে লোকটা প্রিয়াংকার পিছনে চিত হয়ে উলটে পড়ল৷
‘শাবাশ, মহেন্দ্র!’ বললেন অনুজ দাশগুপ্ত৷ টার্গেট শুটিং-এ মহেন্দ্র শর্মার কোনও জুড়ি নেই৷ তাই যে-কোনও এনকাউন্টারে ওকে সঙ্গে নেন অনুজ৷
প্রিয়াংকা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিল৷
অনুজ ছুটে গিয়ে নিজের রিভলভারটা কুড়িয়ে নিলেন৷ তারপর চটপট পৌঁছে গেলেন প্রিয়াংকার কাছে৷ ওর হাত ধরে টেনে তুললেন৷ বললেন, ‘কোনও ভয় নেই৷ য়ু আর সেফ৷’ মহেন্দ্রকে লক্ষ করে চেঁচিয়ে বললেন, ‘শিগগির চলো, প্রিয়াংকাকে নিয়ে আমরা এখুনি বেরিয়ে যাব৷ আমি লালবাজারে ইনফর্ম করছি৷ তোমারও জলদি ডাক্তার দেখানো দরকার৷’
মহেন্দ্র সামান্য হেসে বললেন, ‘তেমন সিরিয়াস কিছু নয়, স্যার—৷’ কথা বলতে-বলতে মেঝেতে পড়ে থাকা ডেডবডিটার দিকে একবার তাকালেন শুধু৷ তারপর ওঁরা প্রিয়াংকাকে নিয়ে সাবধানে রওনা হলেন৷
গোডাউনের বাইরে এসে সদরের দিকে কয়েক পা এগোতেই অন্য দুজন অফিসার একটা লোককে পাকড়াও করে অনুজদের মুখোমুখি হলেন৷ লোকটার পায়ের কাছটা লাল রঙে মাখামাখি৷
একজন অফিসার আমতা-আমতা করে বললেন, ‘একটা হুডলাম ছিটকে পালিয়ে গেছে, স্যার৷ এক্সট্রিমলি সরি৷’
অনুজ বললেন, ‘ইটস ও. কে.৷ আজ না হয় কাল জালে পড়বেই৷ এই অপারেশানে প্রিয়াংকাই আমাদের মেন কনসার্ন৷ আমরা দুজন এখন প্রিয়াংকাকে নিয়ে সোজা মানিকতলা থানায় যাচ্ছি৷ আপনারা এখানকার চ্যাপ্টার ক্লোজ করে যাঁর-যাঁর হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করুন৷ আমি সব জায়গায় ইনফর্ম করে দিচ্ছি৷ ও—ভালো কথা৷ ওই গোডাউনটায় একটা বডি আছে৷’ ইশারায় গোডাউনের দিকে দেখালেন অনুজ : ‘টেক কেয়ার অ্যাবাউট ইট…৷’
ততক্ষণে আরও তিনজন অফিসার বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছেন৷ প্রত্যেকের হাতেই খোলা রিভলভার৷
অনুজ তাঁদের হাতের ইশারা করে বললেন, ‘এভরিথিং ইজ আন্ডার কন্ট্রোল—৷’
তারপর প্রিয়াংকাকে নিয়ে মহেন্দ্রকে সঙ্গে করে বাড়ির বাইরে এলেন৷ সেখানে তখন কৌতূহলী জনতার ভিড়৷ নানা গুঞ্জন৷ ডিজিটাল ক্যামেরা আর ভিডিয়ো ক্যামেরা নিয়ে কেউ-কেউ ছবি তুলছে৷
ভিড় ঠেলে অনুজ এগিয়ে চললেন৷ সামনে এখন অনেক কাজ৷
মিমো আর বাবলি বাড়িটার দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল৷ দরজার দিকে নজর রাখছিল৷ হঠাৎই দেখল, একজন কালোমতন মহিলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় দৌড়নোর ভঙ্গিতে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে৷
মহিলা যখন ওদের খুব কাছাকাছি এসে গেছে তখনই পরপর দুটো জোরালো শব্দ শোনা গেল৷ বোধহয় গুলির শব্দ৷
মিমোর কী মনে হল, বাবলিকে বলল, ‘এই মেয়েটাকে শিগগির ধর৷ ধরে অন্য অফিসারদের কাছে জমা করে দে৷’
বাবলি অবাক হয়ে বলল, ‘কীসব আলফাল বকছিস! ধরি, তারপর কেস খেয়ে যাই…৷’
‘বলছি ধর৷ কেউ কিছু বললেই স্মার্টলি বলবি ‘‘পুলিশ’’৷’
ব্যস, বাবলি ওর পাসওয়ার্ড পেয়ে গেল৷ একদৌড়ে মহিলার কাছে গিয়ে ‘পুলিশ’ বলেই খপ করে হাত চেপে ধরল৷ তারপর টানতে-টানতে নিয়ে চলল রাস্তার মোড়ের দিকে৷
মহিলা হাউমাউ করে কাঁদছিল৷ তাই দেখে দু-একজন লোক কৌতূহলে এগিয়ে আসতেই বাবলি হাত নেড়ে সরে যেতে ইশারা করে তেড়ে উঠে বলল, ‘সাইড৷ সাইড৷ কুইক৷ পুলিশ৷ কিডন্যাপিং-এর কেস৷’
আশ্চর্য! মন্ত্রের মতো কাজ হল৷ বাবলি নির্বিঘ্নে একজন অফিসারের কাছে পৌঁছে গেল৷ মহিলাকে জমা করে বলল, ‘স্যার, আমি ইন্সপেক্টার দাশগুপ্তর সঙ্গে এসেছি৷ ওই বাড়িটা থেকে গুলির আওয়াজ পেলাম—৷’
সঙ্গে-সঙ্গে অফিসারটি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷
বাবলি কাজ শেষ করে ফিরে চলল মিমোর কাছে৷
মিমো বাড়ির দরজার দিকে নজর রাখছিল৷ হঠাৎ দেখল, একটা লোক সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভিড় করতে থাকা লোকজনকে হাতের ধাক্কায় সরিয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে৷
সঙ্গে-সঙ্গে ছুট লাগাল মিমো৷ একটু পরেই লোকটাকে প্রায় ধরে ফেলল৷ পিছন থেকে এক ধাক্কা মারতেই লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাস্তায়৷ মিমো ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল৷ কিন্তু লোকটা ততক্ষণে চিত হয়ে জোড়া পায়ের লাথি ছুড়ে দিয়েছে মিমোর ঝুঁকে পড়া শরীরের দিকে৷