ওঁর কথা বলার মধ্যেই আরও দুটো গাড়ি এসে হাজির হল৷ গাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ ব্যস্তভাবে নেমে পড়ল৷ অনুজ দাশগুপ্ত ফোনে কথা বলা শেষ করে ওঁদের কাছে এগিয়ে গেলেন৷ কয়েকজনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দ্রুত পরিচয়ের পালা শেষ করলেন৷ তারপর হাত নেড়ে-নেড়ে ইশারা করে নানারকম নির্দেশ দিতে লাগলেন৷
মিমো আর বাবলি বুঝতে পারছিল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝোড়ো অ্যাকশান শুরু হবে৷
৷৷ছয়৷৷
আসল বাড়িটা খুঁজে পেতে ওঁদের বেশিক্ষণ সময় লাগল না৷ হাঁটা পথে বাড়িটা মিনিটখানেক৷ বাড়ির সামনে সরু পিচের রাস্তা৷ রাস্তার অবস্থা ভালো নয়৷ এখানে-ওখানে গর্ত আর ফাটল৷ আর যানবাহন বলতে সাইকেল রিকশো আর সাইকেল—কখনও একটা কি দুটো মোটরবাইক৷
নানান দিকে সতর্ক পাহারার ব্যবস্থা করে চারজনের একটা দল নিয়ে এই সরু রাস্তাটায় ঢুকে পড়েছেন দাশগুপ্ত৷ সঙ্গে মিমো আর বাবলি৷
বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা ফাঁকা জমির পাশে মিমোদের অপেক্ষা করতে বললেন অনুজ৷ আরও বললেন, প্রিয়াংকা যদি ফোন করে তা হলে ওকে বলতে যে, ও যেন ভয় না পায়৷ আর যদি কোনও বিপদের আভাস দেখা দেয় তা হলে মিমোরা যেন সোজা টাটা সুমোর দিকে ছুট লাগায়৷
মিমোরা বাড়িটা দেখতে পাচ্ছিল৷ বাড়ির পাশ ঘেঁষে ইটের পাঁজা৷ তার পাশে স্তূপাকার স্টোনচিপ আর বালি৷ একটা সাইনবোর্ডও বাড়ির দেওয়ালে দেখা যাচ্ছে৷
বাড়ির কাছে গিয়ে পকেটের মোবাইল ফোনটা অফ করে দিলেন অনুজ৷ ওঁর দেখাদেখি অন্য অফিসাররাও তাই করলেন৷ এনকাউন্টারের সময় মোবাইলের আওয়াজ অন্যমনস্ক করে দিতে পারে৷
চাপা গলায় ‘রেডি’ বলে অনুজ দরজার ফ্রেমে লাগানো কলিংবেলের বোতাম টিপলেন৷
কোনও সাড়া নেই৷
আবার বোতাম টিপতেই একজন মহিলা দরজা খুললেন৷ কুচকুচে কালো গায়ের রং, চোখজোড়া অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, নাকে নথ৷
একটা শব্দও খরচ না করে মহিলাকে পাশ কাটিয়ে ঝড়ের গতিতে ঢুকে গেলেন ওঁরা চারজন৷ আর্মস হাতে তুলে নিয়ে চিতার ক্ষিপ্রতায় এদিক-ওদিক ছিটকে গেলেন৷ অনুজ চেঁচিয়ে বললেন, ‘শুট অ্যাট সাইট৷’
অফিসারদের কে একজন বললেন, ‘ও. কে., স্যার৷’
বাড়িটা দোতলা৷ সামনে ফাটল ধরা সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন৷ পাশে খানিকটা খোলা জায়গা৷ তারপরই বাগান৷ বাগান বলতে কয়েকটা কলাগাছ, আর তার সঙ্গে গোটাতিনেক পেয়ারা আর তেঁতুল গাছ৷
বাগানের পাশ ঘেঁষে একটা বড়সড় ঘর৷ মাথায় টালির দোচালা৷ ওটা গোডাউন হতে পারে ভেবে অনুজ সেদিকে ছুটলেন৷ একইসঙ্গে ‘প্রিয়াংকা! প্রিয়াংকা!’ বলে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন৷
মহেন্দ্র শর্মা রিভলভার উঁচিয়ে বাগানটা একদৌড়ে পরখ করে নিয়েই ছুটলেন বাড়ির দিকে৷ অন্য দুজন অফিসার তখন যে বাড়ির অন্য ঘরগুলো সার্চ করছেন সেটা লাথি মেরে দরজা খোলার ‘দড়াম! দড়াম!’ আওয়াজে ভালোই বোঝা গেল৷
গোডাউনের দরজা বন্ধ কিংবা ভেজানো ছিল৷ অনুজ ছোটার গতি এতটুকুও না কমিয়ে বাঁ-কাঁধের ধাক্কায় দরজার পাল্লা ছিটকে দিয়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে পড়লেন৷ দুটো পাক গড়িয়ে যখন সামনে রিভলভার তাক করে উপুড় হয়ে তাকালেন তখন পাথর হয়ে গেলেন৷
ঘরটাকে গোডাউনই বলা যায়৷ দেওয়ালে ঘেঁষে কয়েকটা সিমেন্টের বস্তা, প্লাস্টার অফ প্যারিসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের ড্রাম, আরও কত কী! তা ছাড়া বাতাসে হালকাভাবে চুনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে৷
ঘরের মেঝেতে পাতা বিছানায় একটি একুশ-বাইশ বছরের ফরসা সুন্দরী মেয়ে হাঁটুগেড়ে বসে আছে৷ গায়ে গাঢ় নীল আর হালকা সবুজ মেশানো সালোয়ার কামিজ৷ ওর দু-চোখ ভয়ে গোল-গোল হয়ে আছে৷ কারণ, ওর ঠিক পিছনেই ঘাপটি মেরে বসে আছে রোগামতন একটা লোক—মেয়েটার বাঁ-কাঁধের কোণ থেকে উঁকি মারছে, আর ডানহাতের পিস্তলটা মেয়েটার ডান কানের নীচে চেপে ধরে আছে৷
লোকটা চাপা গলায় হাসছিল৷ ওর ছোট-ছোট চোখে তির-বেঁধানো দৃষ্টি৷
অনুজ হালকা গলায় বললেন, ‘প্রিয়াংকা?’
ভয়ার্ত মেয়েটা ওপর-নীচে মাথা নেড়ে বলতে চাইল, ‘হ্যাঁ—হ্যাঁ৷’
ওর পিছনে লুকিয়ে থাকা শত্রু ব্যঙ্গ করে হাসল৷ মেয়েটাকে বলল, ‘প্রিয়াংকা তোমার টিকটিকি কাকুকে বলো ওই লোহার যন্ত্রটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিতে—৷’
প্রিয়াংকা থরথর করে কাঁপতে লাগল৷ ওর মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না৷
লোকটা এবার দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে অনুজকে হুমকি দিল, ‘শিগগির রিভলভারটা ছুড়ে ফেলে দে৷ নইলে এই মেয়েটাকে উড়িয়ে দেব৷’
অনুজ আর ইতস্তত করলেন না৷ ঘরের একপাশে কতকগুলো লোহার পাইপ পড়েছিল—রিভলভারটা সেদিকে ছুড়ে দিলেন৷ লোহায়-লোহায় টক্কর হল৷ ‘ঠং’ শব্দ উঠল৷
এমন সময় একটা এরোপ্লেনের গর্জন শোনা গেল৷ তারমধ্যেই পরপর দুটো ফায়ারিং-এর শব্দ৷ শব্দগুলো বাড়ির দোতলার দিক থেকে এল৷
অনুজ দ্রুত ভাবছিলেন৷ দোতলায় কী হল কে জানে! ওঁর গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছিল৷ এত কাণ্ড করে, এত কষ্ট করে, প্রিয়াংকাকে যদিও-বা খুঁজে পাওয়া গেল, শেষ পর্যন্ত হয়তো শেষরক্ষা হল না৷
রিভলভার ধরা লোকটাকে জরিপ করছিলেন অনুজ৷ লোকটার চোখে একটা ঠান্ডা পেশাদার ভাব৷ মনে হচ্ছিল, এরকম পরিস্থিতি ওর কাছে নতুন কিছু নয়৷
তবুও চেষ্টা না করলেই নয়৷
তাই বললেন, ‘পুলিশ বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে৷ আর কোনও পথ নেই৷’