মোড়টা পেরোনোর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মিমোর মোবাইল বেজে উঠল৷ বাবলি চাপা গলায় বলে উঠল, ‘প্রিয়াংকা!’
কিন্তু না—মিমোর মায়ের ফোন৷
উতলা মাকে ঠান্ডা করতে মিমোকে বেশ কষ্ট করতে হল৷ ও বারবার করে বলল, পেট ভরে টিফিন খেয়েছে৷ কোনও ভয় নেই৷ ‘স্যার’ ওদের সঙ্গেই গাড়িতে বসে আছেন৷ মা যেন ওর জন্য বসে না থেকে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করে নেয়৷
মিমো ফোন ছাড়তে-না-ছাড়তেই দাশগুপ্তর ফোন বেজে উঠল৷
এপাশের কথা শুনে বোঝা গেল, লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ফোন৷
‘…ওরা মিস্টার মজুমদারকে ফোন করেছিল?…কার ফোন থেকে?…ও, প্রিয়াংকার ফোন থেকে?…কী বলছে?…ওঃ, সেই একই মাইক্রো-ক্যাসেট! তো লাইনটা ট্যাপ করা গেছে? বাঁচালেন—মেনি থ্যাংকস! কিন্তু প্রিয়াংকার মোবাইল থেকে করা কলটা কোন এরিয়ার টাওয়ারের টাই-আপ থেকে আসছে সেটা জানা যায়নি? মানে…এয়ারপোর্টের কাছাকাছি কোন টাওয়ার-বেস-স্টেশান থেকে…মানে…৷ তাই নাকি? ও. কে. ও. কে.৷ আমরা এখুনি সেই টার্গেট ধরে এগোচ্ছি৷ আ লট অফ থ্যাংকস!…হ্যাঁ, হ্যাঁ—দরকার হলেই আমি রিং করে নেব৷ ডিসি ডিডি ওয়ান কেসটায় দারুণ ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছেন? সেটা আমাদের গুডলাক বলতে হবে৷ হ্যাঁ—ঠিক আছে৷ ওভার অ্যান্ড আউট৷’
দাশগুপ্তর ফোন শেষ হতেই মিমো আগ্রহ নিয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকাল৷ একদিকের কথাবার্তা শুনে ব্যাপারটা মোটামুটি বোঝা গেলেও শেষদিকের ওই টাওয়ারের ব্যাপারটা পুরো জানা যায়নি৷ তাই কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর ও জিগ্যেস করল, ‘স্যার, মোবাইল ফোনে তো এরিয়ার নাম ওঠে৷ আর ভোডাফোন, এয়ারটেল—এসব কোম্পানির কাছে শুনেছি নানান মডার্ন যন্ত্রপাতি আছে৷ ওরা সব জানে৷ কথাবার্তাও টেপ করে রাখতে পারে৷ প্রিয়াংকার মোবাইল ফোন থেকে কিডন্যাপাররা ওর বাবাকে ফোন করেছিল শুনলাম৷ তা হলে সেই কল থেকে…৷’
হাতের ইশারায় মিমোকে থামিয়ে দিলেন দাশগুপ্ত৷ তারপর সামনের রাস্তার দিকে আড়চোখে নজর রেখে বললেন, ‘ঠিকই প্রশ্ন করেছ৷ ওটা জানা গেছে৷ প্রিয়াংকা কৈখালি এরিয়ায় আছে৷ অন্তত ওর মোবাইল ফোনের টাওয়ার তাই বলছে৷ যদি না বদমাশগুলো আমাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্যে ওর ফোনটা নিয়ে কৈখালি এলাকায় এসে ফোন করে থাকে৷ প্রিয়াংকার মোবাইলে ভোডাফোনের কানেকশান৷ ওরা নিজেদের ডিপার্টমেন্টে এনকোয়ারি করে কৈখালি এরিয়ায় ওদের টাওয়ারটা এগজ্যাক্টলি কোন বাড়ির ছাদে বসানো আছে সেটা চেক করে একটু পরেই জানাচ্ছে৷ ততক্ষণে আমরাও ট্রাই করে দেখি…৷’
ওদের গাড়ি তেঘরিয়ার নতুন ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে৷ সামনে ফাঁকা মসৃণ রাস্তা৷ গাড়ি ঘণ্টায় নব্বইতে চলছে৷ জানলা দিয়ে হু-হু করে বাতাস ঢুকছে৷ মহেন্দ্রর লম্বা চুল পাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে৷
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর অনুজ দাশগুপ্ত আবার মুখ খুললেন৷ পাইলটকে লক্ষ করে বললেন, ‘ধনিয়া, আর-একটু পরেই আমরা কৈখালির মোড়ে এসে পড়ব৷ ওই মোড়ে ডানদিক নেবে৷ তারপর চিড়িয়ামোড় পার করে গাড়ি সাইড করবে৷’
পাইলট ধনিয়া গাড়ি চালাতে-চালাতেই ঘাড় নাড়ল৷
দাশগুপ্ত এবার মোবাইল ফোন নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন৷ বোতাম টিপে ফোন করতে শুরু করলেন৷
‘হ্যালো, ইন্সপেক্টার অনুজ দাশগুপ্ত বলছি৷ অপারেশান ব্ল্যাকের কো-অর্ডিনেটর৷…কৈখালি এরিয়া থেকে কিডন্যাপাররা প্রিয়াংকার বাবাকে কনট্যাক্ট করেছিল৷ আমরা চিড়িয়ামোড়ের কাছে যাচ্ছি৷ আপনারাও কনভার্জ করুন৷ তারপর তিনতলা সবুজ রঙের ফ্ল্যাটবাড়ি, মোবাইল ফোনের টাওয়ার—রেড অ্যান্ড হোয়াইট—আর লাস্ট পয়েন্টার হল সিমেন্ট, বালি, স্টোনচিপের গোডাউনে গ্রাউন্ড ফ্লোরে মেয়েটা রয়েছে৷ পসিবলি কোনও বিল্ডার, মানে, সিভিল কন্ট্রাক্টরের বাড়ি৷ সেই বাড়িতে বিল্ডারের অফিসও থাকতে পারে৷ তবে সার্ভিস প্রোভাইডারের—মানে, ভোডাফোন কোম্পানির কাছ থেকেও যখন-তখন আমরা মোবাইল টাওয়ারটার এগজ্যাক্ট লোকেশান পেয়ে যেতে পারি৷ পেলেই আপনাদের ইনফরম করব৷…আপনারা কেয়ারফুলি কনভার্জ করুন৷ লালবাজার থেকেও গাড়ি আসছে৷ টপ লেভেল থেকে ইনস্ট্রাকশন আছে, যে-করে-হোক মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে৷ দরকার হলে এনকাউন্টার করতে হবে৷ তবে আমি ফাইনাল ‘‘ও. কে.’’ সিগন্যাল দেওয়ার পর৷ …হ্যাঁ, ঠিক আছে৷ ওভার অ্যান্ড আউট৷’
গাড়ি কৈখালির মোড়ে এসে ডানদিকের রাস্তায় ঢুকল৷ অনুজ দাশগুপ্ত মহেন্দ্র শর্মাকে লক্ষ করে বললেন, ‘মহেন্দ্র, আর্মস রেডি রাখবে৷ লোকগুলো মনে হয় ডেঞ্জারাস৷ যদি দরকার হয়, শুট টু কিল৷’
ছোট্ট করে হাসলেন মহেন্দ্র৷ বললেন, ‘আপ বেফিকর রহিয়ে, স্যার৷ সোজা দু-চোখের মাঝখানে…৷’
মহেন্দ্রর কথায় মিমো ভেতরে-ভেতরে কেঁপে উঠল৷ মহেন্দ্র কত সহজে দু-চোখের মাঝখানে গুলি করে ক্রিমিনাল খতম করার কথা বলছেন! মিমো টের পেল ওর বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ শুরু হয়ে গেছে৷
চিড়িয়ামোড় যতই এগিয়ে আসছিল, অনুজ দাশগুপ্ত ততই ওঁর মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন৷ ক্রমশ উত্তেজনার পারা যে বাড়ছে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল৷
চিড়িয়ামোড়ে পিচের রাস্তার বাঁকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওদের টাটা সুমো বাঁ-দিকে বাঁক নিল৷ তারপর আবার ডানদিকে৷ তারপর বেশ খানিকটা এগিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাশগুপ্ত ধনিয়াকে গাড়ি সাইড করতে বললেন৷ ধনিয়া গাড়ি থামাতেই অনুজ দাশগুপ্ত নেমে পড়লেন৷ ওঁর ইশারায় মিমো, বাবলি আর মহেন্দ্রও নামলেন৷