মউলি কমলাবালা গার্লস হাইস্কুলে পড়ে৷ অচ্যুতদের পাশের বাড়িতেই থাকে, অথচ সবসময় কুলদীপকে ফোন করে অচ্যুতকে খবর দেয়৷
মউলি খুব ছটফটে, শাড়ি পরতে ভালোবাসে না, বেণী দুলিয়ে হাঁটে৷ একদিন বিকেলে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল অচ্যুত৷ খেয়াল করেনি যে, ওদের ছাদে দাঁড়িয়ে মউলি ওর ঘুড়ি ওড়ানোর হাস্যকর চেষ্টা দেখছে৷
‘যারা সবসময় লেখাপড়া করে তারা ঘুড়ি ওড়াতে গেলে এরকমই হয়—৷’
ঘুড়ি ওড়ানো থামিয়ে ফিরে তাকাল অচ্যুত৷ ওর ময়ূরপঙ্খী ঘুড়িটা গোঁত খেয়ে সামনের বাড়ির শিউলি গাছে আটকে গেল৷
তাই দেখে মউলি খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল৷
অচ্যুত বলল, ‘আমি মোটেই সবসময় লেখাপড়া করি না—তা হলে এখন ঘুড়ি ওড়াচ্ছি কী করে৷’
ঠোঁট বেঁকাল মউলি : ‘আজকের ব্যাপারটা তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট৷ তুমি দিনরাত লেখাপড়া করো বলেই তো আমার পড়ায় মন বসে না—৷’
ধুত, যত্তসব উলটোপালটা কথা৷ ওর অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল অচ্যুত৷ বলল, ‘এরকম আবার হয় নাকি!’
‘হয়৷ দেখবে, আজ আমার কী দারুণ পড়ায় মন বসবে৷ মাঝে-মাঝে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হলে বেশ হয়…তা হলে সব কাজে আমার মন বসবে৷’
অচ্যুত কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না৷ ও ছাদের পাঁচিলের কাছে এসে সাত-আট ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মউলিকে দেখছিল৷ মউলির মাথার পিছনে সূর্য অস্ত যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল৷
মাঝে-মাঝে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হলে বেশ হয়…৷ তার মানে?
মউলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘সকালে আর বিকেলে ছাদে এসে একটু ফ্রেশ বাতাস তো নিতে পারো৷ তা হলে দেখবে, ভালো হবে৷’
‘কার?’
‘দুজনেরই৷’
মউলির মুখে সূর্যের তেরছা আলো পিছলে গেল৷ ও চটপট ঘুরে দাঁড়িয়ে একরকম ছুটেই চলে গেল৷
সেদিন অচ্যুত ছাদে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছিল৷ ঘুড়ি-লাটাই হাতে নিয়ে মউলির এলোমেলো কথার মানে বোঝার চেষ্টা করেছিল৷
তারপর থেকে অচ্যুত লক্ষ করেছে, মউলির কাজের কিছু বলার থাকলে ও কুলদীপের মারফত বলে পাঠায়৷ ইতিহাস কোচিং-এ যখন পড়তে যায় তখনও ও অচ্যুতের সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না৷ বরং ছাদে যখন দেখা হয় তখন অনেক সহজভাবে অনেক উলটোপালটা অকাজের কথা বলে৷ বলে, ‘তুমি ভিতু, তোমার মাথায় বুদ্ধি নেই৷ কী করে অঙ্কে একশোয় একশো পাও কে জানে!’
অচ্যুত জবাব না দিলেও ওর কথাগুলো নিয়ে চুপচাপ বসে ভাবে৷
এখন কুলদীপ যে-নোটটার কথা বলেছে সেটা মউলি চেয়ে পাঠিয়েছিল কুলদীপের মারফত৷ আবার সেটা ফেরতও আসবে কুলদীপের হাত দিয়ে৷ তা হলে তো মউলি কুলদীপের কাছ থেকেই নোটটা নিতে পারত! কারণ, নগেনস্যারের ডিকটেশান থেকে ওরা সবাই নোট নিয়েছিল৷ সেদিন মউলি আসেনি৷
আবার একদিন ছাদে দেখা হতে অচ্যুত এই অদ্ভুত ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা’ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল৷ উত্তরে মউলি হেসে বলেছিল, ‘এতে একটা অন্যরকম মজা আছে—তুমি বুঝবে না৷’
ওর ভ্যাবাচ্যাকা মুখের দিকে তাকিয়ে একটু পরে মউলি বলেছে, ‘ঠিক আছে, আমি দুটো এক্স্যাম্পল দিয়ে তোমাকে বোঝাচ্ছি৷ সামনাসামনি কথা বলার চেয়ে টেলিফোনে কথা বললে কত ভালো লাগে৷ আবার সেই কথাগুলো চিঠি দিয়ে বলাবলি করলে…ওঃ, ফ্যান্টাস্টিক৷’
একটু চুপ করে থেকে অচ্যুতকে দেখল মউলি৷ তারপর জিগ্যেস করল, ‘কিছু বুঝলে?’
অচ্যুত মাথা নাড়ল৷ সত্যিই ও কিছু বোঝেনি৷
তাই এখন কুলদীপের কথায় ও শুধু ঘাড় হেলাল৷
তখনই ওর চোখ গেল স্কুলের দোতলার বারান্দার দিকে৷
সত্যবানস্যার বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে একমনে সিগারেট খাচ্ছেন৷ নীচে বানজারার ঘরের কাছে যে অত হইচই, ভিড়, সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপও নেই৷
হঠাৎই মাঠে একটা শোরগোল ব্যস্ততা শুরু হল৷ ছাত্রের দল প্রায় ছুটে চলে গেল স্কুল বিল্ডিং-এর কাছে৷ হুড়মুড় করে যার-যার ক্লাসরুমের দিকে রওনা হল৷
ওদের কথাবার্তার টুকরো শুনে অচ্যুতরা বুঝল হেডস্যার এসে গেছেন৷ পিছন ফিরে তাকাতেই ওরা হেডস্যারকে দেখতে পেল৷
হেডস্যার মোহনলাল পুরকায়স্থ রোগা শরীরটাকে টান-টান করে মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছেন৷ মাথায় টাক, চোখে চশমা, ভাঙা গাল, চোয়াল শক্ত৷ দেখলেই বোঝা যায় বেশ কড়া ধাতের মানুষ৷ সবসময় ডিসিপ্লিন বজায় রাখতে চান৷ কিন্তু আজ প্রেয়ার হবে কি না কে জানে! বানজারা ঘণ্টা বাজাতে পারেনি৷ তা ছাড়া অনেকটা দেরিও হয়ে গেছে৷
কিন্তু প্রেয়ারের ঘণ্টা বাজল—দেরিতে হলেও৷ হেডস্যার পরিস্থিতির দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন৷ এখন বানজারার গোরু-বাছুরের মৃতদেহের নিশ্চয়ই একটা গতি হবে৷ কিন্তু কোন প্রাণী ওদের গলার অমন হিংস্র কামড় বসিয়েছে সেটা জানা যাবে কী?
ক্লাস বসল৷ অচ্যুত ভালো করে পড়ায় মন দিতে পারছিল না৷ বারবার ভাবছিল, স্কুলে হঠাৎ এসব কী শুরু হল!
টিফিনের সময় প্রতীক ওকে জিগ্যেস করল, ‘কী রে, রাজীব আজ এল না?’
অচ্যুত বলল, ‘দেখছি তো আসেনি—৷’ একইসঙ্গে ওর মনে পড়ে গেল, রাজীব আজ টিফিনের জন্য কেক-প্যাটিস কিনতে পরেশদার দোকানে নেমেছিল৷
তা হলে কি হঠাৎ করে ওর জ্বর-টর হল!
চুরির ব্যাপারটা ধরা পড়ার পর থেকে রাজীব ওদের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে৷ নিজের অন্যায়ের জন্য বারবার ওদের কাছে দুঃখ করেছে, ক্ষমা চেয়েছে৷ অচ্যুত ভাবল, রাতে একবার ফোন করে রাজীবের খবর নেবে৷ কিন্তু তখনই খেয়াল হল, ওর কাছে তো রাজীবের ফোন নম্বর নেই৷ তখন ও প্রতীককে বলল ফোন করে রাজীবের খবর নিতে৷