চারটি রহস্য উপন্যাস
আমি পিশাচ
৷৷এক৷৷
আমি একজন পিশাচ৷ এ ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় আমার নেই৷ কবে কীভাবে আমার জন্ম তা জানি না৷ আমার বয়েস কত তাও জানা নেই৷ শুধু জানি, রক্ত আমার একমাত্র খাদ্য৷ রক্তের পিপাসা আমাকে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়৷ এখনও যে পথ চলছি সেও ওই রক্তের টানে৷ পিপাসায় বুক শুকিয়ে আসছে আমার৷
আমাকে কেমন দেখতে?
বলছি৷ তবে শুনে যেন অবাক হয়ে যেয়ো না৷
আমার কোনও নির্দিষ্ট চেহারা নেই৷ যখন যেখানে থাকি সেইরকম চেহারা নিয়ে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিই৷ যেমন, যখন জঙ্গলে থাকি তখন গাছের পাতা কিংবা গাছের বাকল হয়ে যাই৷ পুকুরপাড়ে থাকলে ঘাস-পাতা, আগাছা, কিংবা মাটির চেহারা নিই৷ এটা ছদ্মবেশ যদি বলো তো তাই৷
ভিজে, স্যাঁতসেঁতে, নোংরা জায়গায় আমি থাকতে ভালোবাসি৷ তাই আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হল মানুষ বা পশুর শরীর৷ ওদের শরীরের ভেতরটা নরম, স্যাঁতসেঁতে, দুর্গন্ধময়, নোংরা—আবার একইসঙ্গে রক্তের তাপে উষ্ণ৷ ওদের শরীরে আমি নিশ্চিন্তে বহুদিন থাকতে পারি৷ আর ওদের দিয়ে আমার রক্তের তৃষ্ণা মেটাই৷ আমার ইচ্ছেয় ওরা অন্যের শরীরে ধারালো দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে নেয়৷ ওরা বুঝতেও পারে না, ওরা আসলে আমার তেষ্টা মেটাচ্ছে৷ কারণ, ওদের শরীরে ঢুকে পড়ার পর থেকেই ওদের মস্তিষ্ক চলে আমার কথায়৷ অর্থাৎ, ওদের শরীর আর মন—দুই-ই দখল করে ফেলি আমি৷
তবে পশুর চেয়ে মানুষই আমার বেশি পছন্দ৷ কারণ, মানুষের রক্তের স্বাদ সবার সেরা৷ আর মানুষ শিকার করাও সহজ৷ তারপর, আমার হয়ে সেই মানুষ—কিংবা অমানুষ রক্তপিশাচ—যখন মানুষ শিকার করে, তখন তার কাজটাও সহজ হয়ে যায়৷
আঃ! ভাবতেই কত তৃপ্তি!
কিন্তু এ-কাজে বিপদও আছে৷
আমার দখলে থাকা অমানুষগুলো যখন ধরা পড়ে যায় তখন ওরা শাস্তি পায়৷ অন্যান্য সুস্থ মানুষ ওদের খতম করে৷ তখন আমাকে পালিয়ে বাঁচতে হয়৷ এক দেহের আশ্রয় ছেড়ে ছুটতে হয় অন্য আস্তানার খোঁজে৷
বুঝতেই পারছ, মানুষ-পিশাচগুলোর বিনাশ হলেও আমার বিনাশ নেই৷
তা হলে কি আমি অমর? কে জানে!
তবে আত্মা যদি অমর অবিনশ্বর হয় তা হলে প্রেতাত্মা কিংবা পিশাচের অমর হতে অসুবিধে কী!
পথ চলতে-চলতে যখন ভীষণ একঘেয়ে আর ক্লান্ত লাগছে ঠিক তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল৷ সকাল থেকেই মেঘের সাজ-সাজ রব চোখে পড়েছিল, দুপুর পেরোতেই তার কান্নাকাটি শুরু হল৷
চলতে আর ইচ্ছে করছিল না৷ তেষ্টায় আমার ভেতরটা ছটফট করছিল৷ তাই সামনের দোতলা বাড়িটায় ঢুকে পড়লাম৷
প্রকাণ্ড বাড়ি৷ তার লাগোয়া খেলার মাঠ আর বাগান৷ মাঠে বর্ষার সবুজ ঘাস৷ কোথাও-কোথাও জল জমে আছে৷ ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে৷ ওরা বোধহয় এই তুমুল বর্ষার জন্যেই অপেক্ষা করছিল৷ এখন খুশিতে টগবগে হয়ে কলরোল শুরু করে দিয়েছে৷
যাক, এবার আমার কাজ হল বিশ্রাম আর আরাম৷ আর তার জন্যে চাই একজন মানুষ—যার শরীরে আমি আশ্রয় নেব৷ তারপর…৷
.
৷৷দুই৷৷
সত্যবানস্যার বোর্ডে অঙ্ক করছিলেন৷ কালো বোর্ডের ওপরে ওঁর চক-ধরা আঙুল তাড়াহুড়ো করে আলপনা এঁকে চলেছে৷ অঙ্ক যেন স্যারের পোষা পাখি৷ কী সুন্দর স্যারের কথা শোনে! কোনও অঙ্কই স্যারের আটকায় না৷ ধরেই স্যাটাস্যাট করে দেন৷ সেইজন্যেই অচ্যুত, ঋদ্ধিমান, বাসব, সৌরভরা সত্যবানস্যারের নাম দিয়েছে ‘স্যাটাস্যাট’৷
স্যার বোর্ডে অঙ্ক করছিলেন৷ আর ক্লাস নাইনের ছেলেরা মাথা নীচু করে চুপচাপ সেটা খাতায় টুকে নিচ্ছিল৷ অচ্যুত অঙ্কে দারুণ—সবসময় একশোয় একশো পায়৷ কিন্তু বীজগণিতের এই অঙ্কটা ওরও আটকে গেছে৷ হল অ্যান্ড নাইটের ‘হায়ার অ্যালজেব্রা’ থেকে এই অঙ্কটা স্যার আগের দিন করতে দিয়েছিলেন৷
মাথা ঝুঁকিয়ে অঙ্ক টোকা শেষ হতেই কন্দর্প অচ্যুতকে আলতো করে খোঁচা মারল৷
অচ্যুত পাশে ফিরে তাকাতেই কন্দর্প ফিসফিস করে বলল, ‘অ্যাই, আমার ব্যাগ থেকে সাত টাকা চুরি গেছে৷’
অচ্যুত অবাক হল না৷ কারণ, গত সাত-আটদিন ধরে ওদের সেকশানে এই চুরির ব্যাপারটা শুরু হয়েছে৷
প্রথম যে-চুরিটা ওদের নজরে পড়েছিল সেটা ঋদ্ধিমানের ব্যাগ থেকে চার টাকা উধাও হওয়ার ঘটনা৷ সেটা ওরা কেউই খুব একটা আমল দেয়নি৷ ভেবেছে ঋদ্ধিমানের হয়তো ভুল হয়েছে৷ ভুল করে টাকাটা অন্য কোথাও রেখে এসেছে৷
কিন্তু তারপর, ওদের বন্ধু কুলদীপের ব্যাগ থেকে বারো টাকা উধাও হতেই অচ্যুতরা নড়েচড়ে বসেছে৷
ক্লাসে কুলদীপের গায়ের জোরই সবচেয়ে বেশি৷ ওর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে কেউ পারে না৷ তা ছাড়া ও রোজ ব্যায়াম করে, বক্সিং ক্লাবে বক্সিং শেখে৷
টাকা চুরি যেতেই কুলদীপ তো রেগে আগুন৷ ও সবাইকে শাসিয়ে বলল, ‘চোর ধরা পড়লে এক ঘুসিতে নাক ফাটিয়ে বারো টাকার শোধ নেব৷’
কিন্তু চুরির ব্যাপারটা থামল না৷ যেমন আজ কন্দর্পের টাকা চুরি গেছে৷ সুতরাং দুটো পিরিয়ডের ফাঁকে ওরা চার-পাঁচজন মিলে টিচার্স রুমে গিয়ে বাংলার অমিয়স্যারকে সব জানাল৷ স্যার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘হাতেনাতে তস্করকে না ধরা পর্যন্ত তো কোনও প্রমাণ নেই! যদি তোরা নক্তচরকে লাল হাতে ধরতে পারিস, তা হলে প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে আদ্যোপান্ত অবধান করিয়ে শাস্তি দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷’