মারপিট? অবাক হলো রানা। আরে না। অত তাড়াহুড়ো নেই আমার। ওসব হবে পরে। যদি দেখি কথা বেরোচ্ছে না তোমার মুখ থেকে।
বাঁকা এক টুকরো হাসির আভাস খেলে গেল লোকটার ঠোঁটের কোণে। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। সোজা হয়ে যখন দাঁড়াল রানার মাথা ছাড়িয়ে আরও আধ হাত উঠে গেল ওর মাথাটা। শুধু লম্বায় নয়, চওড়াতেও লোকটা। রানার দেড়গুণ। পেটা শরীর। রানার মুখের কথাগুলো তাই হাস্যকর শোনাল। ওর কাছে। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা গ্রহণ করাই স্থির করল লোকটা। ঘাড়টা সামান্য, একটু কাত করে ফাঁইটিং পিকচারের দস্যু-সর্দারের ভঙ্গিতে বলল, কি ব্যাপারে কথা বের করতে চাও?
এই ধরো, আমার ঘরে তুমি কি করছ…সেটা দিয়ে শুরু করা যায়। তারপর আলাপ করা যেতে পারে কে তোমাকে পাঠিয়েছে, কেন পাঠিয়েছে সে সব বিষয়ে।
বিষণ্ণ হাসি হাসল লোকটা। এসব চেষ্টা করে কোন লাভ নেই, মিস্টার। একটা কথাও বের করতে পারবে না আমার মুখ থেকে। অনেক চেষ্টা করে দেখেছে পুলিস, একটা শব্দও বের করতে পারেনি। আইন আমার ভাল করেই জানা আছে। আমাকে দিয়ে কোন কথা বলাতে পারবে না। আইন বলে, কোন কথা প্রকাশ করা বা না করার অধিকার রয়েছে আমার।
দরজার ওই ওপাশ পর্যন্ত এসেই দাঁড়িয়ে গেছে আইন, বলল রানা। এপাশে তুমি আমি দুজনেই রয়েছি আইনের আওতার বাইরে। এখানেও একটা আইন অবশ্য রয়েছে…জঙ্গলের আইন। হয় মারো, নয় মরো।
রানার বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই ডাইভ দিল লোকটা। নিচু হয়ে পিস্তলের লাইন অফ ফায়ার বাঁচাল ঠিকই, কিন্তু রানার হাঁটুর নিচে চিবুক নামাতে পারল না লোকটা। বিদ্যুৎবেগে এক পা এগিয়ে প্রচণ্ড এক গুতো। লাগাল রানা হাঁটু দিয়ে ওর থুতনি বরাবর। তীক্ষ্ণ ব্যথা বোধ করল রানা হাঁটুতে। সেই হিসেবে আধঘণ্টার জন্যে শুয়ে পড়বার কথা লোকটার, কিন্তু আশ্চর্য সহ্য ক্ষমতা ওর, মোক্ষম আঘাত পেয়েও রানার বাম পা ধরে হ্যাঁচকা এক টান দিয়ে ভারসাম্য টলিয়ে দিল রানার। হুড়মুড় করে দুজনেই পড়ল মেঝের ওপর। হাতু থেকে খসে কয়েক ফুট দূরে গিয়ে পড়ল রানার পিস্তলটা। পরবর্তী আধ মিনিট যুদ্ধরত বন্য জন্তুর মত গড়াগড়ি খেলো ওরা মেঝের। ওপর-একবার এ ওপরে, একবার ও। সেই সঙ্গে বৃষ্টির বেগে ঘুসি চালাচ্ছে দুজন একে অপরের ওপর। লোকটার শারীরিক ও মানসিক বল অবাক করল রানাকে। বল প্রয়োগ না করে কৌশল প্রয়োগ করছে রানা এখন। মারিজুয়ানা টেনে স্বাভাবিক রিফ্লেক্স হারিয়ে না ফেললে কি ঘটত বলা যায় না, কারণ আনআর্মড কমব্যাটে সে কোন অংশে কম যায় না রানার থেকে, তার ওপর ওর গায়ে রয়েছে রানার দ্বিগুণ শক্তি। ঠিক আধ মিনিট পর দুজনেই যখন উঠে দাঁড়াল আবার, দেখা গেল বামহাতে চেপে ধরে আছে রানা লোকটার ডান হাত, হাতের কব্জি মুচড়ে ঠেলে তুলে এনেছে ওটাকে একেবারে শোলডার ব্লেডের কাছে।
কব্জিটা আরেকটু ওপরে তুলতেই, গোঙানির মত শব্দ বেরোল লোকটার মুখ থেকে, কিন্তু অভিনয় করছে কিনা সঠিকভাবে বোঝার জন্যে আরও খানিকটা উঁচু করল রানা হাতটা। পিঠের কাছে কড়কড় আওয়াজ পেয়ে বুঝতে পারল সে, আর খানিকটা তুললেই মড়াৎ করে ভেঙে যাবে হাত। এইবার ঠেলে নিয়ে এল সে লোকটাকে ব্যালকনির রেলিঙের ধারে। রেলিংটা ওর পেটে বাধিয়ে ঠেলে শূন্যে তুলে ফেলল ওর শরীরের নিম্নাংশ। বাম হাতে রেলিং আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করল লোকটা, কিন্তু বেকায়দা অবস্থায় ধরতে পারল না শক্ত করে, পেছন থেকে সামান্য একটু ধাক্কা দিলেই সোজা নেমে যাবে সে সত্তর ফুট নিচের রাস্তায় মাথা নিচু পা উঁচু অবস্থায়।
তুমি পুশার না অ্যাডিক্ট? কানের কাছে মধুর কণ্ঠে প্রশ্ন করল রানা।
জান-প্রাণ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল লোকটা, চট করে ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে আরেকটু চাপ দিল রানা ওর মুচড়ে ধরা হাতে, তারপর মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে বলল, চিৎকার করে লোক ডাকবার সুযোগ পাবে। না। উত্তর দাও।
পুশার। ফুঁপিয়ে উঠল লোকটা। বিক্রি করি।
কে পাঠিয়েছে তোমাকে এখানে?
সেটা কিছুতেই বলব নাঃ যা খুশি তাই..উহ।
শেষ পাঁচটা সেকেন্ড একটু ভেবে দেখো। সিদ্ধান্ত তোমার। উত্তর না দিলে ঠেলে ফেলে দেব। ফুটপাথের দিকে একবার চেয়ে দেখো…ওই ওখানটায় হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকবে তোমার লাশ, মুখের গন্ধ শুকেই পুলিস বুঝে নেবে কেন তোমার হঠাৎ উড়বার শখ হয়েছিল।
খুন! কঁকিয়ে উঠল লোকটা। শুধু এই খবরটার জন্যে মানুষ খুন করতে পারো না তুমি।
পারি। সহজ কণ্ঠে বলল রানা। তোমরা সে অধিকার দিয়েছ। আমাকে। আজই বিকেলে তোমাদের লোক খুন করেছে আমার এক লোককে, বিনা অপরাধে। কেবল তোমাদেরই হত্যা করবার অধিকার আছে, আর কারও নেই? তাছাড়া এটা হত্যা কোথায়? চেয়ে দেখো, মাত্র সত্তর ফুট, পাঁচ সেকেন্ডও লাগবে না তোমার পৌঁছতে কারও বুঝবার ক্ষমতা নেই যে আমিই দায়ী এজন্যে। দেখো।
উরু দিয়ে ঠেলে রেলিঙের ওপর দিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে দিল রানা ওর শরীর ফুটপাথটা দেখবার সুবিধের জন্যে, ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাচ্ছে দেখে ডানহাতে কলার খামচে ধরে টেনে আনল আবার।
কি দেখলে? কথা বলার ইচ্ছে আছে?
গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বের করল লোকটা। রেলিঙের ওপর থেকে নামিয়ে ঠেলে নিয়ে এল রানা ওকে ঘরের মাঝখানে।