রাস্তা পেরিয়ে ওপাশে চলে গেল রানা। লোকটার বেশ খানিকটা পেছন পেছন চলল। শখানেক গজ গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে আসতে শুরু করল লোকটা। চোখেমুখে স্পষ্ট উদ্বেগ। ফিরতি পথে প্রত্যেকটা খোলা। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে খুঁজছে সে রানাকে। ইন্দোনেশিয়ান রেস্তোরাঁতেও ঢুকল, দুশ সেকেন্ড পর বেরিয়ে এল সেখানে রানাকে না পেয়ে। রেমব্র্যান্ট হোটেলে ঢুকে লবি, লাউঞ্জ, বার খুঁজে ফিরে এল সে রাস্তায়। পাগল-দশা হয়েছে ওর। উদভ্রান্ত ভঙ্গিতে চাইছে এদিক ওদিক, দিশাহারার মত পথ চলতে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে লোকের গায়ে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ একটা টেলিফোন বুদে ঢুকল লোকটা, দুই মিনিট পর বেরিয়ে এল কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে যেন মেরেছে কেউ। সোজা মাল্টপ্লেইনের ট্রাম স্টপেজের দিকে চলল লোকটা। এবার, পিছু পিছু গিয়ে রানাও দাঁড়াল লাইনে।
তিন কোচের একটা ট্রাম এসে দাঁড়াতেই প্রথম কোচে উঠে পড়ল ছাই রঙা লোকটা, দ্বিতীয় কোচে উঠে বসল রানা। একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে বসল, যাতে নজর রাখা যায় লোকটার ওপর।
ড্যাম-এ পৌঁছেই নেমে পড়ল লোকটা, রানাও নামল। এই ড্যামই হচ্ছে। অ্যামস্টার্ডামের মেইন স্কয়ার। রাজপ্রাসাদ, নিউ চার্চ, ইত্যাদি অনেক ঐতিহাসিক দর্শনীয় বস্তু সাজানো রয়েছে রাস্তার দুই ধারে। কিন্তু এসব কোনকিছুর প্রতি ক্ষেপ না করে হোটেল ক্র্যাসনাপোলস্কির পাশ দিয়ে একটা সাইড রোড ধরে এগিয়ে গেল লোকটা, তারপর বায়ে মোড় নিয়ে ডকের। দিকে এগোল আউডেজি ভুর্বাগোয়াল খালের ধার ঘেঁষে। আধ মাইল এগিয়ে ডাইনে ঘুরে গুদাম আর পাইকারী বিক্রেতাদের ওয়্যারহাউজে ঠাসা পূরানো। শহরের দিকে চলল সে এবার। লোকটাকে অনুসরণ করবার ব্যাপারে কোন সমস্যা দেখা দিল না, ডাইনে-বায়ে কোনদিকে না চেয়ে এক মনে হেঁটে, চলেছে সে মাথা নিচু করে, ধমক ও গালাগালির উত্তরে কি কি জবাব দেবে খুব সম্ভব তারই মহড়া চলেছে ওর মাথায়।
সরু একটা গলিতে ঢুকল লোকটা, একটু ইতস্তত করে গলিমুখে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল রানা। যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে বিদেশী পর্যটক, কোনদিকে যাবে ভাবছে, যদিও জানে যে কোন একদিকে রওনা দিলেই চলে, ওর কাছে সব রাস্তাই সমান। লোকটার চলার গতি বেড়ে যাওয়ায় রানা বুঝতে পারল, গন্তব্যস্থলের খুব কাছাকাছি এসে গেছে বলেই এই কর্ম তৎপরতার আভাস। ঠিকই। মান আলোকিত গলিটার মাঝামাঝি গিয়ে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে তরতর করে উঠে গেল লোকটা কয়েক ধাপ, চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে গেল একটা স্টোর হাউজের ভিতর।
ধীরে পায়ে এগোল রানা। সরু রাস্তার দুপাশে পাঁচতলা উঁচু সারি সারি পুরানো দালান, মনে হয় এক্ষুণি বুঝি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে ঘাড়ের ওপর। প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে সাইনবোর্ড লাগানো কোন না কোন কোম্পানীর। স্টোর হাউজ। কেমন একটা ছমছমে ভাব নির্জন রাস্তাটায়। যেতে যেতে সহজ ভঙ্গিতে চাইল রানা ডানপাশে। যে দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়েছে ছাই-রঙা লোকটা তার গায়ে লেখা–ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানী। যেমন চলছিল। ঠিক সেই গতিতেই এগিয়ে গেল রানা সামনের মোড়ের দিকে।
.
অত্যন্ত সাদামাঠা এক হোটেল-যেমন বাইরেটা, তেমনি ভেতরটা। খটখটে কয়েকটা আসবাব, দেখে মনে হয় নিলামে কেনা। বিছানার ওপর পাশাপাশি বসে আছে সোহানা ও মারিয়া। রানা বসল ঘরের একমাত্র আরাম কেদারাটায়।
কি খবর? মায়াময় নৈশ অ্যামস্টার্ডামের এক নির্জন হোটেলকক্ষে অপরূপ সুন্দরী দুই রমণী–একা। সব ঠিকঠাক তো?
না, জবাব দিল মারিয়া এক অক্ষরে।
না? অবাক হওয়ার ভান করল রানা। না মানে?
হাত তুলে কামরাটার চারদিকে দেখাল মারিয়া। দেখুন, নিজেই চেয়ে। দেখুন না।
চারদিকে চেয়ে কিছুই বুঝতে পারল না রানা। দেখলাম, কিন্তু বুঝলাম না।
এই ঘরে মানুষ বাস করতে পারে? আপনি পারবেন?
ও, এই কথা? হাসল রানা। না। সত্যি বলতে কি, এই ঘরে আমি বাস। করতে পারব না। কিন্তু তোমাদের মত খেটে খাওয়া টাইপিস্টকে তো আর। ফাঁইভ-স্টার হোটেলে নিয়ে গিয়ে তুলতে পারি না। এই ঘর তোমাদের জন্যে। ঠিকই আছে। এখানে কারও চোখে পড়বার সম্ভাবনা নেই। অন্তত এটাই আশা করছি। তোমাদের বক্তব্য কি? তোমাদের চিনতে পেরেছে কেউ? মাথা নাড়তে দেখে বলল, তোমরা কাউকে চিনতে পেরেছ প্লেনে?
ঠিক একই ভাবে মাথা নেড়ে একই সঙ্গে বলল দুজন, না।
শিফলে পৌঁছে পরিচিত কাউকে দেখেছ?
না।
কেউ কোন বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি তোমাদের প্রতি?
না।
ঘরটা পরীক্ষা করে দেখেছ? লুকোনো মাইক্রোফোন বা কিছু পেলে?
না।
বাইরে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
কেউ অনুসরণ করেছিল?
না।
তোমাদের অনুপস্থিতিতে সার্চ করা হয়েছে এ ঘর?
না।
মারিয়ার ঠোঁটে হাসির আভাস দেখে হাসল রানা প্রশ্রয়ের হাসি। বলল; বলে ফেলো। মজার ব্যাপারটা কি ঘটল?
না। মানে… একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল মারিয়া, এই চোর-পুলিস খেলার কি সত্যিই কোন মানে, দুজন নিরীহ বিদেশী টাইপিস্ট আমাদের পেছনে কেন কেউ
আহ, থামো! মারিয়াকে থামিয়ে দিল সোহানা। এর মধ্যে হাসির কিছুই নেই।
এয়ারপোর্টের ঘটনা সম্পর্কে জানা আছে তোমাদের? জিজ্ঞেস করল রানা।
খুনের ব্যাপারে তো? বলল মারিয়া। কে একজন খুন হয়েছে। এয়ারপোর্টে। শুনোছ, আপনি নাকি চেষ্টা করেছিলেন খুনীকে ধরতে…