নাহ, যা আশা করেছিল তার কিছুই ঘটল না। রানা ভেবেছিল, ও বাথরূমে মনের সুখে ভিজছে মনে করে এই সুযোগে তালাহীন সুটকেসের মধ্যে কি আছে দেখবার চেষ্টা করবে ওয়েটার, অন্তত চারপাশে উৎসুক দৃষ্টি বুলাবে. সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে কিনা দেখবার জন্যে কিন্তু না, কোনদিকে না চেয়ে সোজা টেবিলের ওপর কফির ট্রে নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল লোকটা। যাবার সময় দরজাটা ভিড়িয়ে দিতে ভুলল না।
এতে অবশ্য কিছুই প্রমাণ হয় না, বুঝতে পারল রানা। এর ফলে, ধরে নেওয়া যায় না যে এই হোটেলে শত্রুপক্ষের কেউ নেই, কিংবা ওর পরিচয় ও উদ্দেশ্য এদের সবার অজানা। বাথরূম থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই করিডরে বেরোবার দরজায় তালা দিল, তারপর কফিগুলো বেসিনে ঢেলে দিয়ে বন্ধ করে দিল শাওয়ার। চলে এল ব্যালকনিতে।
ব্যস্ত সড়কের দিকে চেয়ে রানা বুঝল ওখান থেকে ওর কার্যকলাপ দেখার উপায় নেই কারও, সামনের দালানগুলোর কোন জানালা বা ব্যালকনিতেও কাউকে দেখতে পেল না সে। সামনে ঝুঁকে আশেপাশের কোন ঘরের ব্যালকনি থেকে এদিকে কেউ চেয়ে রয়েছে কিনা দেখল ডাইনে বায়ে মাথা ঘুরিয়ে। না। কেউ নেই দুপাশের কোন ব্যালকনিতে। রেলিঙের ওপর দাঁড়িয়ে এক হাতে একটা পাইপ আর এক হাতে হাতের কার্নিস ধরে. উঠে পড়ল সে ওপরে।
কেউ নেই ছাতে, উঁকি দিয়ে দেখে নিয়ে টেলিভিশনের এরিয়েল বাঁচিয়ে এগোল সে ফায়ার এসকেপের দিকে। তেতলা পর্যন্ত নেমে এল রানা ফায়ার এসকেপের সিঁড়ি বেয়ে, তারপর চাবি লাগাল করিডরের দরজায়। বার কয়েক চেষ্টা করতেই খুলে গেল তালা, দরজাটা সামান্য ফাঁক করে শূন্য করিডর দেখে বেরিয়ে এল সে দরজার ওপাশ থেকে। এবার হেলেদুলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে।
রিসিপশনে নতুন লোক। সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, বেল বয় বা ডোরম্যান, কাউকেই দেখতে পেল না সে। একদল সদ্য আগত টুরিস্ট ভিড় করে আছে রিসিপশন ডেস্কের সামনে। ভিড় ঠেলে, এর ওর কাঁধে মৃদু টোকা দিয়ে ডেস্কের কাছাকাছি পৌঁছল রানা, হাত বাড়িয়ে ডেস্কে জমা দিল ঘরের। চাবিটা, তারপর ধীর পদক্ষেপে চলে গেল বারে। সেখানেও থামল না, একটা সাইড ডোর দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।
মুষল ধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে, রাস্তাঘাট ভেজা। কিন্তু এখন একফোঁটাও পড়ছে না আর। ওভারকোটটা খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিল, চারপাশে উৎসুক দৃষ্টি ফেলতে ফেলতে এগোল সে, যেন নৈশ-অ্যামস্টার্ডামের রূপ। একেবারে মুগ্ধ করে ফেলেছে তাকে।
হেরেনগ্র্যাচে সপ্তদশ শতাব্দীর রাজকুমারদের বাড়িগুলো দেখছিল রানা, হঠাৎ ঘাড়ের পেছনে কেমন যেন একটা সুড়সুড়ির মত অনুভূতি হলো ওর। এক্সট্রা সেনসরি পার্সেপশন হোক বা যাই হোক, নিজের মধ্যে একটা ক্ষমতা আছে–অনুভব করে রানা। পরিষ্কার বুঝতে পারল, অনুসরণ করা হচ্ছে ওকে।
কিছুদূর এগিয়ে একটা খালের ধারে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল সে, যেন প্রাকৃতিক শোভা দেখছে। একটা সিগারেটের আধা-আধি শেষ করে বুঝতে পারল আপাতত ওকে খুন করবার ইচ্ছে নেই কারও। সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও বেশি কাছে এল না লোকটা, বিশগজ দূরে আরেকটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে সে-ও শোভা দেখছে। শিফল এয়ারপোর্টের পিস্তল তুলে গুলি করেনি ইসমাইলের হত্যাকারী, এই নির্জন খালের পারে জায়গামত একটা গুলি ঢুকিয়ে দিয়ে সম্মানের সাথে পানিতে নামিয়ে দিলে টেরও পাবে না। কাকপক্ষী–কিন্তু সে চেষ্টা করল না কেউ। আপাতত এরা শুধু ওর গতিবিধি। আর কাজকর্মের ওপর দৃষ্টি রাখতে চাইছে। ভালই তো-রাখুক।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল রানা, হাই তুলল, তারপর উঠে _এল বড় রাস্তায়। ডানদিকে মোড় নিয়ে লীডেস্ট্রাট ধরে এগোল সহজ ভঙ্গিতে। মাঝে মাঝে টুকিটাকি উইন্ডো শপিং করছে, সেই ফাঁকে কাঁচের গায়ের। প্রতিফলন দেখে বুঝে নিচ্ছে অনুসরণকারীর অবস্থান। রানা থামলেই সেই লোকটাও থেমে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করে কোন দোকানের ডিসপ্লে। ছাই রঙের স্যুট ও সোয়েটার নোকটার, টুপিটাও ছাই রঙের।
সামনের মোড়ে আবার ডানদিকে ঘুরল রানা। সিঙ্গেল ক্যানেলের তীরে সারর্বাধা ফুলের দোকান। বেশ কিছুদূর এগিয়ে একটা টকটকে লাল গোলাপ কিনে গুজল কোটের কলারে। ত্রিশ গজ দূরে সেই লোকটাও ফুল কিনছে। রওয়ানা হয়ে গেল রানা।
সামনের মোড়ে আবার ডানদিকে ঘুরল রানা। লোকটা চোখের আড়াল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত দ্রুত পায়ে এগোল ভিযেলস্ট্রাট ধরে। চল্লিশ কদম, গিয়েই চট করে ঢুকে পড়ল একটা ইন্দোনেশিয়ান রেস্তোরাঁর ভেড়ানো দরজা ঠেলে। সোজা গিয়ে টয়লেটে ঢুকল।
দশ সেকেন্ডের মধ্যে বেরিয়ে এল সে টয়লেট থেকে। ওভারকোটটা গায়ে চড়িয়ে নিয়েছে, পকেট থেকে একটা নরম ফেল্টের ট্রিলবি হ্যাট বের। করে পরে নিয়েছে, চোখে চড়িয়েছে জিরো পাওয়ারের একজোড়া পুরানো মডেলের তারের চশমা। রানা যখন রেস্তোরাঁর দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় পড়ল, ঠিক সেই সময়ে হন্তদন্ত হয়ে চারপাশে চাইতে চাইতে সামনের দিকে চলেছে ছাই-রঙা অনুসরণকারী। ওভারকোট পরা পরিবর্তিত রানাকে ভালমত দেখবারও প্রয়োজন বোধ করল না লোকটা, একবার আবছাভাবে চোখ বুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশে খুজছে সে রানাকে। এই দরজায় ওই দরজায় উঁকি দিয়ে দেখছে সে রানা ঢুকেছে কিনা।