ওয়েলকাম, মিস্টার রানা, বলল লোকটা। আশা করি অ্যামস্টার্ডাম আপনার কাছে ভাল লাগবে।
এ ব্যাপারে অতটা আশাবাদী হতে পারল না রানা, কাজেই জবাব না। দিয়ে রেজিস্ট্রেশন কার্ড পূরণে মন দিল সে। যেন মহামূল্যবান রত্নের অলঙ্কার। নিচ্ছে, এমনি ভাবে পূরণ করা কার্ডটা হাতে নিল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। রানাকে আর এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে বুড়ো বেল বয়ের দিকে চাইল সে। শরীরের ওপরের অংশ একপাশে বাকিয়ে রানার ভারী সুটকেস হাতে। এলোমেলো পা ফেলে এদিকে এগোচ্ছে বেল বয়।
বয়! ছশো বাইশ নম্বর।
কথাটা বলেই অত্যন্ত বিনয় সহকারে রানার হাতে তুলে দিল সে একটা, চাবি। চাবিটা পকেটে ফেলে দুই পা এগিয়ে বুড়োর হাত থেকে সুটকেসটা নিল রানা ঝ হাতে, টিপস দিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। আমিই নিতে পারব।
কিন্তু সুটকেসটা অনেক ভারী মনে হচ্ছে, মিস্টার রানা, বলল। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আন্তরিক কণ্ঠে। ওটা ওখানেই নামিয়ে দিন, আমি অন্য লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি ওপরে।
মৃদু হেসে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল রানা সুটকেস হাতে। ভারী তো মনে হবেই ভাবল সে। পিস্তল, গোলাবারুদ, সাইলেন্সর, বার্গলার্স-টুল, এবং সেই সঙ্গে আরও কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি মিলে কমপক্ষে দশ সের ওজন বাড়িয়ে দিয়েছে সুটকেসের। কিন্তু তাই বলে ওর অনুপস্থিতিতে ভিতরের জিনিসপত্র ঘাঁটবার সুযোগ সে দিতে পারে না কাউকে। একবার হোটেল কক্ষে পৌঁছতে পারলে ওসব লুকিয়ে রাখবার জায়গার অভাব হবে না, কিন্তু তার আগে সুটকেসটা হাতছাড়া করা যায় না।
সিক্সথফ্লোরের বোতাম টিপে দিল রানা এলিভেটরে উঠে রওয়ানা হওয়ার আগের মুহূর্তে দরজার গায়ের গোল কাঁচের জানালা দিয়ে রিসিপশন ডেস্কের দিকে চাইল সে। হাসি নেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের মুখে। গভীর ভাবে কি সব বলছে লোকটা টেলিফোনের রিসিভারে।
সাততলার লবিতে বেরিয়েই দেখতে পেল রানা ছোট্ট একটা টেবিল, টেবিলের ওপর একটা টেলিফোন, ওপাশে একটা চেয়ার, চেয়ারে বসা ইউনিফর্ম পরা এক স্বাস্থ্যবান ওয়েটার। লোকটার চোখে মুখে একটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ করল সে। এই ধরনের লোকের ব্যবহারে আবছা একটা। বেয়াড়াপনা, একটা তির্যক বেয়াদবি মেশানো থাকে, কিন্তু স্পষ্টভাবে কোন দোষ ধরবার উপায় নেই যে নালিশ করা যায় কর্তৃপক্ষের কাছে।
ছশো বাইশ নম্বরটা কোনদিকে? জিজ্ঞেস করল রানা।
ভুরুজোড়া আধ ইঞ্চি ওপরে উঠল লোকটার, বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখাল। ডানদিকে। তিনটে ঘর ছেড়ে তার পরেরটা। উঠে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, বাক্যের শেষে ছোট্ট একটা স্যার যোগ করাও বাহুল্য বলে বোধ করল সে। মনে মনে বিরক্ত হলো রানা, ইচ্ছে হলো এক থাবড়া দিয়ে ওর চাদিটা ঘোলা। করে দেয়, কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু না বলে আনন্দটা ভবিষ্যতের জন্যে জমা করে রাখাই স্থির করল। যাবার আগে এই লোকটাকে একটু টাইট করে দিয়ে যাবে সে।
তুমি ফ্লোর ওয়েটার না? যেন বেয়াদবিটা চোখেই পড়েনি ওর, এমনিভাবে জিজ্ঞেস করল রানা।
ইয়েস, স্যার, বলে উঠে দাঁড়াল লোকটা। এত সহজে লোকটা কাবু হয়ে যাওয়ায় মন খারাপ হয়ে গেল রানার। যেন রসভঙ্গ হয়ে গেল।
আমার জন্যে খানিকটা কফির ব্যবস্থা করো।
এগিয়ে গিয়ে ছশো বাইশের দরজায় চাবি লাগাল রানা। প্রশস্ত বেডরূম, একটা মাঝারি সিটিংরূম, ছোট্ট একটা কিচেন আর অ্যাটাচড বাথরূম নিয়ে চমৎকার এক সুইট। পিছনে.চওড়া একটা ব্যালকনি।
সুটকেসটা ঘরের কোণে নামিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল রানা। ঠিক নিচেই ব্যস্ত রাজপথ–প্রায় সত্তর ফুট নিচে। খটখটাং শব্দে ট্রাম চলছে, হর্ন বাজাচ্ছে চলন্ত গাড়ি, কিলবিল করছে শয়ে শয়ে মোটর-স্কুটার আর বাইসাইকেল যেন আত্মহত্যার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে ওরা প্রত্যেকে।
ওপর দিকে চাইল রানা। সুইট রিজার্ভ করবার সময়েই টপ ফ্লোরের। কথা বলে দিয়েছিল সে বিশেষ করে। এখান থেকে সবচেয়ে সহজে কিভাবে ছাতে ওঠা যায় বুঝে নিয়ে ফিরে এল ঘরে। সুটকেস খুলে যেসব জিনিস সে আর কারও চোখে পড়তে দিতে চায় না সেগুলো বের করে রাখল রানা। কার্পেটের ওপর। হোলস্টারে পোরা ওয়ালথার পি.পি.কে. ঝুলিয়ে নিল বগলের নিচে, এক্সট্রা ম্যাগাজিন গুঁজে দিল প্যান্টের পেছনের পকেটে। এবার। ক্যানভাসের বেল্টে আঁটা বার্গলার্সটুল কোমরে বেঁধে নিয়ে ভ্রুড্রাইভারটা বের করুল তার থেকে। কিচেনে রাখা ছোট্ট পোর্টেবল ফ্রিজের পেছনটা খুলে এবার বাদবাকি সব জিনিস ঢুকিয়ে দিল সে ওখানে, তারপর দরজা খুলে হাক ছাড়ল। ওয়েটারের উদ্দেশে।
কি হলো? কফি কোথায়?
এবার এক হাঁকেই উঠে দাঁড়াল ওয়েটার, ভাঙা ইংরেজিতে বলল, আসছে, স্যার। এলেই আমি পৌঁছে দেব।
জলদি করো, বলেই দরজা ভিড়িয়ে দিল রানা।
কোমরে বাঁধা বেল্ট থেকে একগোছা চাবি বের করে দরজার চাবির ফুটোয় একের পর এক লাগাতে শুরু করল সে। সপ্তম চাবিটা লেগে গেল। নম্বরটা দেখে নিয়ে যথাস্থানে রেখে দিল সে গোছাটা আবার। বাথরূমে ঢুকে শাওয়ার খুলে দিয়ে ফিরে এল সে বেডরূমে, স্যুটগুলো ঝুলিয়ে দিল ওয়ারড্রোবের হ্যাঁঙ্গারে, একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েক টান দিয়ে জ্বলন্ত অবস্থায় অ্যাশট্রের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল। ঠিক এই সময়ে বেল বেজে উঠতেই একলাফে চলে গেল সে বাথরূমের দরজার সামনে, ওয়েটারকে ভিতরে আসতে বলে ভিতরে ঢুকে ভিড়িয়ে দিল বাথরুমের দরজা, নিচু হয়ে চোখ রাখল কী হোলে।