পরিচিত কিনা? না। এই ভিড়ের মধ্যে লাশটা যদি দাঁড় করিয়ে দেন, চিনতে পারব না।
রানা। মাসুদ রানা।
হয়তো স্বীকার করবেন, মিস্টার রানা, সাধারণ কোন লোক সাধারণত সশস্ত্র খুনীকে তাড়া করে না।
হয়তো সাধারণের চেয়ে একধাপ নিচে আছি আমি।
কিংবা হয়তো আপনার কাছেও পিস্তল রয়েছে?
জ্যাকেটের দুটো বোতাম খুলে লোকটার সন্দেহ ভঞ্জন করল রানা।
আচ্ছা, খুনীকে কি কোনভাবে আপনার পরিচিত মনে হয়েছে? মানে, আগে কোনদিন
কোনদিন না। সত্যি কথাটাই বলল রানা। তবে জীবনে কোনদিন ওই চেহারাটা ভুলতে পারবে না সে, এটাও সত্যি কথা–কিন্তু এ সত্য প্রকাশ করল না সে; মেয়েটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে দুএকটা কথা। জিজ্ঞেস করতে চাই, মিস–
মিস শেরম্যান, বলল মর্গেনস্টার্ন।
আপনি তো খুনীটাকে দেখেছেন। চেহারাটা মনে আছে? মেয়েটা মাথা। নাড়ছে দেখে বলল, মনে থাকার কিন্তু কথা। কাউকে দৌড়াতে দেখলে সবাই সেইদিকে তাকায়। আপনি একেবারে সামনে থেকে দেখেছেন ওকে।
দেখেছি। কিন্তু চেহারা মনে নেই।
মৃত লোকটাকে হয়তো আপনি চিনতে পারবেন। দেখবেন নাকি এক নজর?
শিউরে উঠে মাথা নাড়ল মেয়েটা।
হঠাৎ সরাসরি প্রশ্ন করল রানা, কাউকে রিসিভ করতে এসেছেন?
ঠিক বুঝতে পারছি না একটু যেন অবাক দেখাল মেয়েটাকে।
ইমিগ্রেশনের দরজার মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তাই জিজ্ঞেস করছি। কেউ আসছে এই প্লেনে?
আবার মাথা নাড়ল মেয়েটা। রানা লক্ষ করল, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মেয়েটার মুখ। ঈষৎ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে রানার মুখের দিকে। ভয়। পাচ্ছে পরের প্রশ্নটা কি হবে ভেবে।
তাহলে কেন এসেছেন? ভুরু নাচাল রানা। দৃশ্য দেখতে? এখানে তো, দেখার মত কিছুই নেই?
এসব প্রশ্নের কোন যৌক্তিকতা দেখতে পেল না মর্গেনস্টার্ন, ঠাণ্ডা দৃষ্টি রাখল রানার চোখে।
হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে। খামোকা প্রশ্ন করে ভদ্র মহিলাকে আর বিব্রত করলেও চলবে। এ ধরনের প্রশ্ন করবার অধিকার রয়েছে কেবল পুলিস। অফিসারের।
আমি একজন পুলিস অফিসার, বলল রানা। পাসপোর্ট আর ওয়ার্যান্ট কার্ড বের করে এগিয়ে দিল অফিসারের দিকে। ঠিক সেই সময়ে ইমিগ্রেশনে। এসে ঢুকল সোহানা ও মারিয়া। কপালকাটা রানার রক্তাক্ত চেহারা দেখেই থমকে দাঁড়াল লোহানা, চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া ফুটে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু রানার কড়া ভ্রুকুটি দেখে সামলে নিল মুহূর্তে। ঘাড় ফিরিয়ে মর্গেনস্টার্নের দিকে চাইল এবার রানা। মুখের ভাব সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে লোকটার।
তাই বলুন! আবার চোখ রাখল সে ওয়ার্যান্ট কার্ডে। মেজর মাসুদ রানা, প্যারিস ব্যুরো অফ ইন্টারপোল। এবার বোঝা যাচ্ছে কেন খুনীর। পেছনে ওভাবে দৌড়েছিলেন আপনি, কেন জেরা শুরু করেছিলেন পুলিসের। মত। যাই হোক, আপনার এই পরিচয়পত্র একটু চেক করে দেখতে হবে। আমার।
দেখুন। যেমন ভাবে খুশি পরীক্ষা করে দেখুন। তবে আমার মনে হয়, সেন্ট্রাল হেডকোয়াটারের কর্নেল ভ্যান গোল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করলে অনেক খাটুনি বেঁচে যাবে আপনার।
কর্নেলকে চেনেন আপনি?
মাথা ঝাঁকাল রানা। বলল, তিনিও আমাকে চেনেন। যাই হোক, যা চেক করবার জলদি করুন, আমি বারে গিয়ে বসছি, ওখানেই পাবেন আমাকে। এগোতে গিয়েও থেমে দাঁড়াল রানা তাগড়া পুলিশ দুজনকে অনসূরণ করতে দেখে। বলল, এদের জন্যে, ড্রিঙ্কস কিনতে পারব না আমি, জানিয়ে দিচ্ছি আগে থেকেই।
ঠিক আছে, হাত নেড়ে পুলিস দুজনকে পিছু নিতে বারণ করল মর্গেনস্টার্ন। মেজর মাসুদ রানা পালাবে না।
যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কাগজপত্রগুলো আপনার কাছে রয়েছে, ততক্ষণ তো নয়ই। মেয়েটার দিকে ফিরল রানা। মিস্ শেরম্যান, আপনার ওই জখমের জন্যে আমি আন্তরিক দুঃখিত। দেখে মনে হচ্ছে খুবই কাহিল হয়ে। পড়েছেন। আসুন না, একটা ড্রিঙ্ক নিন?
আপনার সাথে? জুলফির পাশে রুমাল চাপা দিয়ে এমন ভাবে চাইল মেয়েটা রানার দিকে যেন কুষ্ঠরোগী দেখছে। মুখ ফিরিয়ে নিল।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে এগোল রানা বারের দিকে। হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে অবাক হলো সে। প্লেন থেকে নামার পর মাত্র আট মিনিট পার হয়েছে এতক্ষণে। এই আট মিনিটে কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে ওর কাছে এক–অত্যন্ত সুসংগঠিত দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সে এবার; দুই-এত গোপনীয়তা সত্ত্বেও কবে, কখন, কোন প্লেনে করে ইন্টারপোলের লোক আসছে জানা হয়ে। গিয়েছিল ওদের, ইসমাইলের হাত নাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রানার চেহারাও চেনা হয়ে গিয়েছে; তিন-হঠাৎ সামনে পড়ে যায়নি মিস শেরম্যান, ইচ্ছে করেই নষ্ট করা হয়েছে রানার কয়েকটা মূল্যবান সেকেন্ড।
কোথাও মস্ত কোন ভুল করেছিল ইসমাইল, সে ভুলের অর্ধেক মাশুল শোধ করে গেছে সে নিজের জীবন দিয়ে, বাকি অর্ধেকটা চেপে গেছে এখন রানার কাঁধে।
.
০২.
আপাতত আগের প্ল্যান-প্রোগ্রামই অনুসরণ করবার সিদ্ধান্ত নিল রানা। হলুদ মার্সিডিজ ট্যাক্সি এসে থামল ফাঁইভ-স্টার হোটেল কার্লটনের সামনে। মালপত্রের ভার ডোরম্যানের হাতে ছেড়ে দিয়ে ঢুকে পড়ল রানা ভিতরে। রিসিপশন ডেস্কের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে ছিমছাম পোশাক পরা স্মার্ট চেহারার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। সরু গোঁফ, ব্যাকরাশ চুল, মুখে উজ্জ্বল হাসি-সামনের লোকটা পিঠ ফেরাবার সঙ্গে সঙ্গেই যেটা অদৃশ্য হয়ে যাবে, কিন্তু ঝট করে পেছন ফিরলে দেখা যাবে মুহূর্তে ফিরে এসেছে হাসিটা, আগের চেয়েও উজ্জ্বল।