হেনরীকে কাঁধে নিয়ে আবার তেতলায় উঠে এল রানা সরু সিঁড়ি বেয়ে। অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় তালা নেই। লাইট জ্বেলে দেখা গেল বেঘোরে। ঘুমোচ্ছে বিট্রিক্স সোফার ওপর। হেনরীকে নিয়ে পাশের ঘরে যাওয়ার সময় ছায়া পড়ল ওর চোখে, চট করে চোখ মেলে চাইল, তারপর উঠে বসল বিট্রিক্স। পাশের ঘরের বিছানায় কঙ্কালসার দেহটা নামিয়ে দিয়ে ফিরে এল, রানা বসবার ঘরে। কোন কথা না বলে চেয়ে রইল চোখ ডলতে থাকা বিট্রিক্সের দিকে।
কখন বেরিয়ে গেছে টের পাইনি, বলল মেয়েটা অনেকটা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে। রানা যখন কোন কথা বলল না, তখন আবার বলল, সত্যিই টের পাইনি আমি। কোথায় পেলেন ওকে?
তুমি কল্পনা করতে পারবে না কোথায় পেয়েছি। হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছিল একটা ব্যারেল অর্গানের ওপর।
কিন্তু এত রাতে তো…
ব্যারেল অর্গানের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়। মাথা ঝাঁকাল রানা। বুড়ো ছিল না। তালা ভাঙার চেষ্টা করছিল ও।
মাথা নিচু করে বসে রইল বিট্রিক্স। আবার কান্নার সেশন শুরু না হয়, সেই ভয়ে চট করে জিজ্ঞেস করল রানা, এর মধ্যে মাথা নিচু করবার কি আছে? আমি ভাবছি, ব্যারেল অর্গানের প্রতি ওর এত ইন্টারেস্ট কেন.। অদ্ভুত ব্যাপার। গানবাজনা খুব পছন্দ করে বুঝি?
না। হ্যাঁ। সেই ছোটবেলা থেকেই গানবাজনা…
হয়েছে। আর গুলপট্টি মারতে হবে না। কঠোর কণ্ঠে বলল রানা। গানবাজনার ভক্ত হলে ওই বেসুরো ব্যারেল অর্গানের বাজনা না শুনে বরং সেলাই মেশিনের আওয়াজই ওর বেশি পছন্দ করবার কথা। খুবই সহজ একটা কারণ রয়েছে ওর ব্যারেল অর্গানের কাছে যাওয়ার। খুবই সহজ। কারণটা তুমিও জানো, আমিও জানি।
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল বিট্রিক্স রানার চোখের দিকে। ভীতি দেখতে। পেল রানা ওর চোখে। বসে পড়ল সে সোফায়।
বিট্রিক্স?
বলুন?
মিথ্যাভাষণে আমার চেয়ে কোন অংশে কম যাও না তুমি। হেনরীকে খুঁজতে যাওনি তুমি, তার কারণ তোমার ভাল করেই জানা ছিল কোথায় গেছে। ও, ভাল করেই জানা আছে কোথা থেকে ধরে এনেছি আমি ওকে। এমন এক জায়গা, যেখানে অত্যন্ত নিরাপদেই থাকবে ও, এমন এক জায়গা, যেখানে ধরা। পড়বে না ও পুলিসের হাতে; এমনই সম্মানিত জায়গা, যে কেউ কোনদিন ভাবতেই পারবে না ওখানে খুজবার কথা। লম্বা এক শ্বাস ফেলল রানা। থোয়াতে সুইয়ের মজা নেই, কিন্তু নাই-মামার চেয়ে কানা-মামা ভাল।
একেবারে ছাইবর্ণ ধারণ করল বিট্রিক্সের মুখ। ভয় পেয়েছে মেয়েটা এবার। রানা লক্ষ করল থরথর করে কাঁপছে ওর হাত।
কাকে ভয় পাচ্ছ, বিট্রিক্স? ওদের, না আমাকে?
আপনাকে। এতদিন ঠিকই ছিলাম, আপনি
আমি এসেই গোলমাল শুরু করে দিয়েছি। তাই না? কিন্তু একটু ভাল করে ভেবে উত্তর দাও দেখি তোমার কি মনে হয়, কেন আমি তোমার ঘরে আবার ফিরে এসেছি আজ? তোমার ক্ষতি করবার জন্যে? বুঝতে পারছ না, সেটা করতে চাইলে এখানে আসবার কোন প্রয়োজনই ছিল না আমার? তোমার প্রেমে যে পড়িনি সেটা বুঝবার ক্ষমতা তোমার আছে। র্যাকমেইলড হচ্ছ, এই ধারণাটা যদি আমার মনে না আসত তাহলে নিজের ঘুম নষ্ট করে তোমার কাছে ছুটে আসতাম না। আমি তোমাকে শুধু একটা কথাই বলতে চাই নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারছ তুমি। এখনও সময় আছে। ইচ্ছে করলে দিক পরিবর্তন করতে পারো। পরে আর সময় থাকবে না।
ভুল বলছেন। চোখ তুলল বিট্রিক্স। কোন উপায় নেই আমার। শেষ হয়ে গেছি আমি।
মাথা নাড়ল রানা।
হেনরীর কথা যদি বলো, আমি স্বীকার করব, হ্যাঁ, ওর জন্যে কোন রাস্তা খোলা নেই আর। কিন্তু তোমার জন্যে একটা রাস্তা খোলা আছে। একটাই মাত্র রাস্তা। আমার সঙ্গে সহযোগিতা করা। তুমি আমাকে সাহায্য করলে আমি সাহায্য করব তোমাকে।
কিভাবে কি সাহায্য করবেন আপনি আমাকে?
প্রথমত, হেনরীর জীবনটা যারা শেষ করে দিয়েছে, তাদের শেষ করে দিয়ে। তোমার জীবনটা যারা বিষময় করে তুলেছে, তাদের শেষ করে দিয়ে। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে পুলিসের সমস্ত ঝামেলা থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে। কিন্তু আমার সাহায্য দরকার। পৃথিবীর প্রত্যেকেরই দরকার একে অপরের সাহায্য। আমাকে যদি সাহায্য করো, আমি তোমাকে সাহায্য করব যদি কসম খেতে বলো, খেতে পারি। আমার কথায় নিশ্চয়ই টের পেয়েছ, ওদের দিন শেষ হয়ে এসেছে? কি, সাহায্য করবে আমাকে?
দুশ্চিন্তা, হতাশা, ভয়-নানান রকম ভাবের খেলা খেলে গেল বিট্রিক্সের। মুখের ওপর দিয়ে। দুমিনিট চুপচাপ বসে থেকে তিনবার মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সে। সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে পয়েন্ট টু ওয়ান বোরের ছোট্ট একটা। পিস্তল বের করে দিল রানা ওর হাতে।
এটা রেখে দাও। কাজে লাগতে পারে। প্রয়োজন হলেই ব্যবহার করতে দ্বিধা কোরো না।
ঠিক তিন মিনিট পর বেরিয়ে এল রানা অ্যাপার্টমেন্ট হাউজ থেকে। রাস্তার অপর পারে একটা সিঁড়ির ওপর বসে গভীর তত্ত্বালোচনায় মত্ত রয়েছে দুই মাতাল, তর্ক করছে ফিসফিস কণ্ঠে। পিস্তল ধরা হাতটা কোটের পকেটে; পুরে দ্রুতপায়ে এগোল রানা বিশ গজ দূরে পার্ক করে রাখা ট্যাক্সির দিকে। ক্লান্তিতে ঘুম আসছে ওর দুচোখ ভেঙে। বেলা নটার বেশি ঘুমানো যাবে না, দশটার সময় কর্নেল ডি গোল্ডের সঙ্গে সার্চ করতে যাওয়ার কথা ওর ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে।