ছুঁচো মুখো লোকটার একটা চোখ অদৃশ্য হয়ে গেল। দ্বিতীয় গুলিটা ঢুকল দুই চোখের ঠিক মাঝখান দিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করল ওর মুখটা ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসায়। মরা অবস্থাতেই এক পা পিছিয়ে গেল, তারপর যেমন নিঃশব্দে এগোচ্ছিল তেমনি কোন শব্দ না করে হুইপেটটা আঁকড়ে ধরে গড়িয়ে পড়ল মেঝের ওপর। খোলা দরজা দিয়ে পাশের ঘরের দিকে চাইল রানা। এর সঙ্গে আরও লোক আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আক্রমণ না করা পর্যন্ত বোঝা যাবেও না। কাজেই দেরি করবার কোন অর্থ। হয় না। লক্ষ করল, কাঁপছে ওর সর্বশরীর।
সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা, দ্রুতপায়ে চলে এল বাইবেলের ঘরে কেউ নেই। তার পাশের ঘরে তেমনি ঘুমিয়ে রয়েছে হেনরী, অন্যান্য কেবিন খালি-কেউ নেই। এক হ্যাঁচকা টানে কাঁধে তুলে নিল সে হেনরীকে। উঠতে শুরু করল ওপরে। পুলপিটের পেছনের সংজ্ঞাহীন দেহটা নামিয়ে দিয়ে আর। একবার সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা করল রানা গির্জাটা, তারপর বাইরে বেরোবার। দরজাটা সামান্য একটু ফাঁক করে পুরো একমিনিট চেয়ে রইল বাইরের দিকে। কাউকে দেখতে না পেয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।
তিন মিনিটের মধ্যে ট্যাক্সিটা নিয়ে এল সে গির্জার দোরগোড়ায়। ভিতরে। ঢুকে তুলে নিয়ে এল হেনরীকে, পিছনের সীটে বসিয়ে দিতেই ঢলে পড়ল ও গাড়ির মেঝেতে। চট করে চারটাপাশ দেখে নিয়ে আবার রানা ঢুকল গিয়ে গির্জার ভিতর।
মৃত লোকটার পকেট থেকে কিছুই পাওয়া গেল না। বাইবেলটা যথাস্থানে রেখে বামহাতে হুইপেটটা নিয়ে ডানহাতে কোটের কলার চেপে ধরল লাশটার, তারপর ছেড়ে টেনে নিয়ে এগোল দরজার দিকে। একটা। একটা করে বাতি নিভিয়ে, দরজা বন্ধ করে দিয়ে টেনে নিয়ে এল সে লাশটা। ওপরে, বাইরে বেরোবার দরজার মুখে। বাইরেটা আবার একবার ভাল করে। দেখে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
যতটা সম্ভব ট্যাক্সির আড়ালে আড়ালে একেবারে খালের ধারে টেনে নিয়ে এল রানা লাশটা, তারপর আস্তে করে নামিয়ে দিল পানিতে, ঠিক যেমন করে নামাত ওই লোকটা রানার লাশ যদি আর একটা সেকেন্ড সময় পেত। হুইপেটটাও নামিয়ে দিল রানা খালের জলে, তারপর দ্রুতপায়ে চলে এল গাড়ির কাছে। গাড়ির দরজা খুলতে যাবে, এমনি সময়ে গির্জার ঠিক পাশের একটা বাড়িতে বাতি জ্বলে উঠল বাইরের দিকে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেল। সদর দরজা। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল একজন লোক, অনিশ্চিত দৃষ্টিতে চাইল এদিক ওদিক, তারপর এগিয়ে এল ট্যাক্সির দিকে।
লম্বা-চওড়া এক লোক, চকমকে নাইট গাউন গায়ে জড়ানো, একমাথা এলোমেলো পাকা চুল, নাকের নিচে চওড়া একজোড়া পাকা গোঁফ, মুখের ভাবে প্রসন্ন বদান্যতার ছাপ।
কোন সাহায্য দরকার? ঝনঝনে ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করল লোকটা। কোন অসুবিধেয় পড়েছেন?
অসংখ্য ধন্যবাদ, বলল রানা। না, না। অসুবিধে কিসের? কোন অসুবিধে হচ্ছে না আমার।
গির্জার ভিতর থেকে কিসের যেন আওয়াজ শুনলাম মনে হলো?
গির্জার ভিতর থেকে?
হ্যাঁ। আমার গির্জা। ওই যে। আঙুল তুলে গির্জার দিকে দেখাল। লোকটা। আমিই প্যাসটর। রজার। ডক্টর নিকোলাস রজার। আমি ভাবলাম। কোন গুণ্ডা বা ডাকাত ঢুকে পড়ল নাকি ভেতুরে।
আমি না, রেভারেন্স, বলল রানা। গত দশ বছর কোন চার্চের ভেতর। ঢুকিনি আমি।
সমঝদারের মত পাকা মাথা ঝাঁকাল লোকটা। ঈশ্বরবিহীন এক দুনিয়ায় বাস করি আমরা। যেন তাকে ছাড়াই চলে! যাই হোক, এত রাতে আপনি কি করছেন এখানে, ইয়ংম্যান? রাত একটু বেশি হয়ে গেছে না?
নাইট শিফটের ট্যাক্সি ড্রাইভারের জন্যে খুব একটা রাত কোথায়?
আর এই পাল্টা প্রশ্ন তেমন একটা সন্তুষ্ট করতে পারল না বৃদ্ধকে। কয়েক পা। সামনে এগিয়ে উঁকি দিল গাড়ির ভিতর। হেনরীকে মেঝের ওপর পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল ভয়ানকভাবে। মাই গড! গাড়ির ভেতর ডেডবডি!
হেসে উঠল রানা। দাঁড়াল প্যাসটরের মুখোমুখি। ওটা ডেডবডি নয়, রেভারেন্ড। মাতাল এক নাবিক, জাহাজে পৌঁছে দেয়ার জন্যে নিয়ে চলেছি। লোকটা সীট থেকে পড়ে যাওয়াতেই এইমাত্র গাড়ি থামিয়ে সীটে তুলে। বসাতে যাচ্ছিলাম আমি। আবার হাসল রানা। মরা হলে ওকে তুলে বসাবার প্রয়োজন হত না।
এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারল না বৃদ্ধ, দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখব।
রানাকে ঠেলে এগোবার চেষ্টা করল বৃদ্ধ, কিন্তু যেখানে ছিল সেখানেই। ঠেলে রেখে দিল ওকে রানা। কাতর মিনতির মত শোনাল ওর গলাটা। আপনি চাপাচাপি করলে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা খোয়া যাবে, রেভারেন্ড। প্লীজ!
আমি জানতাম! আমি জানতাম! মস্ত কিছু গোলমাল রয়েছে কোথাও। আন্দাজ করতে পেরেছিলাম আমি। স্বীকার করছেন যে, আমি চাপাচাপি। করলে আপনার লাইসেন্স খোয়া যাবে?
হ্যাঁ। চাপাচাপি করলে আপনাকে খালের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলতে হবে আমার, ফলে ক্যানসেল হয়ে যাবে লাইসেন্সটা। অবশ্য, মুচকি হাসল রানা, যদি সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারেন, তবেই।
কি বললেন? খালে ফেললেন? আমাকে? একজন প্যাসটরকে! আপনি দৈহিক হামলার হুমকি দিচ্ছেন আমাকে, স্যার?
হ্যাঁ।
দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে গেল, ডক্টর রজার। সেখান থেকে বলল, আপনার লাইসেন্স প্লেটের নাম্বার আমার মনে থাকবে, স্যার। কাল সকালেই আমি…
রাত বেড়ে চলেছে। আর কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভিং সীটে উঠে গাড়ি। ছেড়ে দিল রানা। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে প্রবল বেগে হাত নাড়াচ্ছে লোকটা মুঠি পাকিয়ে, বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের কোন লক্ষণ নেই ওর ভাবভঙ্গিতে।