কেবিনগুলো সব একবার করে দেখে নিয়ে সামনের দেয়ালের গায়ে একটা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল রানা। কান পেতে শুনল ভিতর থেকে কোন আওয়াজ পাওয়া যায় কিনা। নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। ভিতরে, বাতির সুইচ খুঁজে বের করে টিপে দিল।
এ ঘরে আসবারের কোন বালাই নেই, শুধু চার দেয়ালের গায়ে চারটে উঁচু র্যাক রাখা, র্যাকগুলোর প্রত্যেকটা তাকে ঠাসা রয়েছে বাইবেলের পর বাইবেল। ফাস্ট রিফর্মড চার্চের বাইবেল। জায়গার অভাবে একেক তাকে। তিন সারি করে সাজানো। ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে এই স্টকেরই একটা অংশ দেখে এসেছে সে। এই কিছুক্ষণ আগেই। কাজেই এগুলোর মধ্যে নতুন কিছু পাওয়া যাবে না বুঝতে পারল সে, তবু এগিয়ে গিয়ে ঘাটতে শুরু করল সে বাইবেলগুলো। অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। কাজেই প্রথম বা দ্বিতীয় সারি পরীক্ষা করল না সে, দুই সারি থেকে দুটো বই সরিয়ে তৃতীয় সারি থেকে টেনে বের করে আনল একটা বাইবেল। যা আশা করেছিল, তাই। দেখতে অন্যসব বাইবেলের থেকে তফাৎ নেই কোন, কিন্তু আসলে এটা বই-ই নয়, বইয়ের মত দেখতে বাক্স একটা, ভিতরটা ফাঁপা।
বাংলাদেশে বেশ কিছু উকিল আছে, যারা মক্কেলের কাছে নিজেদের পাণ্ডিত্যের বহর দেখাবার জন্যে চেম্বারের কয়েকটা আলমারি ভর্তি করে রেখেছে এই ধরনের চামড়া বাঁধাই করা ফাপা বই দিয়ে কিন্তু ফাস্ট রিফর্মড। চার্চ মুগ্ধ করতে চায় কাকে?
বাইবেলের মলাট, অর্থাৎ ঢাকনিটা খুলে ভিতরে একবার নজর বুলিয়েই বন্ধ করে দিয়ে এদিক ওদিক চাইল রানা। এঘরে দেখবার আর কিছুই নেই। যে দরজা দিয়ে ঢুকেছে, ঠিক তার উল্টোদিকের দেয়ালে ওই রকম আর একটা দরজা। আবার কান পাতল রানা, খুলল, ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালল।
ছোট্ট একটা শিস বেরিয়ে এল রানার মুখ থেকে। অত্যন্ত আধুনিক ঝকঝকে সব যন্ত্রপাতি সাজানো রয়েছে এ ঘরে। ছোটখাট একটা ফ্যাক্টরি। কি জিনিস তৈরি হয় তার কৌন নমুনা নেই ঘরের কোথাও, কিন্তু মেশিনগুলো যে নিয়মিত ব্যবহার করা হয়, তার চিহ্ন সুস্পষ্ট। মার্সেই শহরের লাভ লজে ঠিক এই রকম আর একটা ফ্যাক্টরি দেখেছিল সে, মনে পড়ল রানার।
ঘরের মাঝামাঝি গিয়েই ওর মনে হলো যেন আবছা একটা শব্দ কানে, এল। যে দরজা দিয়ে ও এইমাত্র ঘরে ঢুকেছে, সেই দরজার কাছে। ঘাড়ের পিছনে সেই সুড়সুড়ি জাতীয় অনুভূতিটা বোধ করল রানা। মনে হলো, পিছন থেকে কেউ চেয়ে রয়েছে ওর পিঠের দিকে, মাত্র কয়েক ফুট দূর থেকে।
কিছুই টের না পাওয়ার ভান করল রানা, যেমন হাটছিল তেমনি আপন মনে হাঁটতে থাকল সামনের দিকে। কিন্তু স্বাভাবিক থাকা খুব কঠিন হয়ে। পড়ল ওর পক্ষে। মনের ভিতর যখন পাই করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিপদের স্বরূপ চাক্ষুষ করবার, কিংবা সৎ করে সরে কোন কিছুর আড়ালে লুকোবার অদম্য ইচ্ছে, যখন রানা পরিষ্কার জানে যে কোন মুহূর্তে একটা থারটি এইট ক্যালিবার অথবা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর বুলেট এসে ঢুকতে পারে মাথার পিছনে-আগামী পদক্ষেপেই ঘটতে পারে ঘটনাটা, তখন সহজু ভঙ্গিতে সোজা হয়ে হাঁটাও সহজ নয়। বিশেষ করে অস্ত্র বলতে যদি বাম হাতে ধরা থাকে, একটা ফাপা ধর্মগ্রন্থের খোলস তাহলে হৃৎকম্প শুরু হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। প্রচণ্ড বেগে লাফাতে শুরু করেছে ওর হৃৎপিণ্ডটা বুকের ভিতর। কোন শাসন মানছে না।
নিজের বোকামিতে ভয়ানক রাগ হলো রানার নিজের ওপর। আর কেউ এই ভুল করলে বিনা দ্বিধায় বলত সে উচিত সাজা হয়েছে ব্যাটা গর্দভের। কি করে নিজে করল সে এই ভুলটা? গির্জার দরজাটা ভোলা দেখে? বাইরের দরজা খোলা, বেজমেন্টে নামবার দরজা খোলা, কোথাও কোন তালা নেই, কোথাও কোন বাধা নেই–যার খুশি আসো, ঢোকো, দেখো। এই অবস্থা দেখে প্রথমেই তো বোঝা উচিত ছিল ওর, একটাই মাত্র কারণ থাকতে পারে এর। সেটা হচ্ছে নিশ্চয়ই সশস্ত্র পাহারাদারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে, যার ওপর হুকুম রয়েছে, ঢুকতে বাধা দেবে না কাউকে, বাধা দেবে বেরোতে গেলে–প্রাণ নিয়ে যেন কেউ বেরিয়ে যেতে না পারে এখান থেকে। নিশ্চয়ই পুলপিট কিংবা আর কোন গোপন জায়গায় চুপচাপ ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। হয়তো আরও কোন দরজা রয়েছে যেটা লক্ষ্যই করেনি সে।
আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে ঘরের শেষ মাথায় পৌঁছল রানা, বামপাশে লেদ মেশিনের মত দেখতে একটা যন্ত্রের ওপাশে কিছু দেখে যেন অবাক হয়েছে এমনি ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে কিছু বলল, তারপর নিচু হয়ে ঝুঁকল যন্ত্রের। আড়ালে–যেন মেঝেতে রাখা কিছু জিনিস পরীক্ষা করে দেখছে। এতক্ষণ। পর্যন্ত সুযোগ দেয়ায় যার-পর-নাই কৃতজ্ঞ রোধ করল সে লোকটার প্রতি। ঠিক দুই সেকেন্ড পর যখন মাথাটা তুলল রানা, পিস্তল বেরিয়ে এসেছে ওর হাতে।
বারো ফুট দূরে দেখতে পেল রানা লোকটাকে। পায়ে রাবার সোলের মোকাসিন, মুখটা ছুঁচোর মত লম্বাটে, উত্তেজনায় ফ্যাকাসে, চোখদুটো। জ্বলছে। ওর হাতে রানার দিকে মুখ করে ধরা রয়েছে পয়েন্ট থ্রী এইট পিস্তলের চেয়েও কয়েকগুণ ভয়ঙ্কর এক পিলে চমকানো হুইপেট। ডিবিবিএল টুয়েলভ বোর শটগানের ব্যারেল কেটে ফেলে দিয়ে তৈরি হয়েছে এই হুইপেট শটরেঞ্জের খুনোখুনিতে এর বাড়া আর কোন অস্ত্র নেই।
হাতে গুলি করবে, না বুকে, নাকি মাথায় চিন্তা করবার সময় পেল না। রানা। যখন এক সেকেন্ডের মধ্যে নির্ধারিত হয়ে যায় দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে কে বাঁচবে আর কে মরবে, সেকেন্ডের দশভাগের একভাগ সময়ের মধ্যেই যে কোন দিকে চলে যেতে পারে জয় বা পরাজয়, সেই মুহূর্তটা মাথা খাটাবার মুহূর্ত নয়–প্রবৃত্তির তাড়নায় কাজ করে তখন মানুষ। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রিগারে চাপ দিল রানা।