তাতে কি হয়েছে? চব্বিশ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল। হাসল রানা। ডোরম্যান নেই, পোটার নেই, ট্যাক্সিম্যান নেই, অর্গান-ভিখারী নেই, অনুসরণ করবার কেউ নেই–ব্যাপার কি? এজন্যে রীতিমত জবাবদিহি করতে হতে পারে আপনার।
প্লীজ.কি বলছেন ঠিক
বুঝতে পারছেন না। আমি নিজেও কি ছাই বুঝে বলছি? যাই হোক, হেয়ার কাটিং সেলুনটা কোনদিকে?
হেয়ার কাটিং সেলুন! এত রাতে আপনি চুল ছাটতে…
বুঝেছি। আবার হাসল রানা। জানা নেই আপনার। ঠিক আছে, আমি– নিজেই খুঁজে নেব।
বেরিয়ে পড়ল রানা। বিশ গজ গিয়ে একটা ডোরওয়ের আড়ালে দাঁড়াল, উঁকি দিল কেউ অনুসরণ করছে কিনা দেখবার জন্যে। তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হলো সে ওর প্রতি কারও তেমন কোন আগ্রহ নেই দেখে। নজর। রাখবার প্রয়োজন বোধ করছে না কেউ ওর গতিবিধির ওপর। কেউ অনুসরণ করছে না। আরও ত্রিশ গজ গিয়ে পুলিস-কারে উঠে পড়ল রানা। ফাস্ট রিফর্মড চার্চ অফ দা অ্যামেরিকান হিউগানট সোসাইটির দুই গলি আগে রাস্তার ধারে পার্ক করে নেমে পড়ল সে ট্যাক্সি থেকে, ক্যানেলের ধার ঘেয়ে সতর্ক পায়ে এগোল গির্জার দিকে।
ক্যানেলের জলে কোন আলোর প্রতিবিম্ব দেখতে পেল না রানা। খালের দুধারে একটা বাড়িতেও আলো জ্বলছে না। গির্জাটাকে আরও শান্ত, আরও নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। বিশাল ক্রেনের প্রকাণ্ড বুমটা মনে হচ্ছে আকাশ ফুড়ে চলে গেছে ওপরে, ভয় ভয় একটা ভাব বিরাজ করছে ওটার চারপাশে। আশেপাশে প্রাণের কোন সাড়া নেই। মনে হচ্ছে গভীর রাতের গোরস্থান।
কাছাকাছি এসে চট করে রাস্তা পেরোল রানা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে দাঁড়াল একটা মোটা থামের আড়ালে, তীক্ষ্ণদৃষ্টি বুলাল চারপাশে। কারও সাড়া বা শব্দ পাওয়া গেল না। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে, ডানহাতে হ্যাঁনডেল। চাপ দিয়ে বাম হাতে চাবির গোছাটা বের করতে যাচ্ছিল, প্রায় চমকে উঠল। সে দরজাটা খোলা দেখে। গির্জার দরজায় তালা না থাকা তেমন কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, কিন্তু রানা হয়তো মনে মনে স্থির নিশ্চিত ছিল যে দরজাটা তালা মারা থাকবে, তাই এতটা অবাক হয়েছে। নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকে বন্ধ করে দিল সে দরজাটা। টর্চটা বেরিয়ে এসেছে, ওর হাতে, দ্রুত একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে আনল সে আলোটা। নিঃসন্দেহ হলো, ও একা।
এবার আরেকটু যত্নের সাথে গিজার অভ্যন্তরটা পরীক্ষার কাজে মন দিল। রানা। বাইরে থেকে যতটা মনে হয় তার চেয়েও ছোট আসলে গির্জাটা। খুবই প্রাচীন। টর্চটা উঁচু দিকে ধরল সে। কোন ব্যালকনি নেই, গোটা কয়েক ধূলিমলিন বন্ধ কাঁচের জানালা বৃয়েছে কড়া রোদ উঠলেও কাঁচের মালিন্য ভেদ করে ভিতরে আলো ঢুকতে পারবে কিনা সন্দেহ। বেরোবার একমাত্র রাস্তা দেখা যাচ্ছে ওই প্রবেশদ্বারই। দ্বিতীয় একটা দরজা দেখা যাচ্ছে ভিতরের ঘরে ঢুকবার, পুলপিট আর প্রাচীন এক অর্গানের মাঝামাঝি জায়গায়। বন্ধ।
এই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল রানা, নবের ওপর হাত রেখে নিভিয়ে দিল টর্চটা। জং ধরা কজায় সামান্য আওয়াজ হলো দরজাটা খুলতে। অতি। সাবধানে পা বাড়াল সে সামনে। ভাগ্যিস সাবধানে বাড়িয়েছিল, নইলে হোঁচট খেয়ে সামনে হুড়মুড় করে পড়তে হত। পাশের ঘরটা আসলে ঘর না–সিঁড়ি ঘর। দরজার পরেই একফুট নিচে প্রথম ধাপ। সাবধানে নামতে শুরু করল রানা ঘোরানো সিঁড়ির ধাপ বেয়ে, মনে মনে আঠারো শুনতেই পৌঁছে গেল, নিচে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। অন্ধের মত দুহাত সামনে বাড়িয়ে এগোল রানা। আশা করছে এক্ষুণি একটা দরজা পাওয়া যাবে, কিন্তু কয়েক কদম গিয়েও যখন দরজা পাওয়া গেল না, থেমে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালল। এবার তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরাল সে টর্চ।কেউ নেই। জানালা বিহীন একটা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে একা।
গোটা গির্জার আয়তনের প্রায় অর্ধেক হবে ঘরটা। সিলিং থেকে একটা উলঙ্গ বালব ঝুলছে তারের মাথায়। দেয়ালের গায়ে সুইচ খুঁজে বের করে টিপে দিল রানা। শতশত বছরের ধুলো জমে আছে কাঠের মেঝের ওপর। ঘরের মাঝখানে গোটা কয়েক চেয়ার-টেবিল পড়ে রয়েছে এলোমেলো ভাবে, দুপাশের দুই দেয়ালের গায়ে সারি বাধা চারটে চারটে আটটা কেবিন। মনে। হচ্ছে, মধ্যযুগীয় কোন কাফে।
পরিচিত একটা গন্ধে নিজের অজান্তেই নাকটা একটু কুঁচকে উঠল রানার। গন্ধটা ডানদিকের কোন কেবিন থেকে আসছে বলে মনে হলো ওর। ছোট্ট টর্চটা বুক পকেটে গুঁজে পিস্তল বের করল রানা। সাইড পকেট থেকে সাইলেন্সরটা বের করে লাগাল পিস্তলের মুখে। তারপর ওটা বাগিয়ে ধরে প্রেতাত্মার মত নিঃশব্দে এগোল সামনে।
প্রথম কেবিনটা খালি। দ্বিতীয়টার সামনে গিয়েই নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল রানা। অতি সাবধানে উঁকি দিয়ে দেখল, না, এটাও খালি। তৃতীয়। কেবিনের দরজার কাছে এসে গন্ধটা প্রবল হলো। সাইলেন্সারের মুখ আর, রানার বামচোখ একই সাথে উঁকি দিল তৃতীয় কেবিনের ভিতর।
এত সাবধান না হলেও চলত। ছোট্ট একটা টেবিলের ওপর দুটো জিনিস চোখে পড়ল রানার একটা অ্যাশট্রের মধ্যে আধ ইঞ্চি লম্বা একটা সিগারেটের টুকরো, আর তার পাশে হাতের ওপর রেখে ঘুমিয়ে থাকা একটা মাথা। মুখটা ওপাশে ফেরানো রয়েছে, কিন্তু এক সেকেন্ডও লাগল না রানার ওকে চিনতে। হেনরী। ওকে যে অবস্থায় খাটে শুইয়ে দিয়ে এসেছিল, তাতে রানার। ধারণা হয়েছিল চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে পড়ে থাকবে ছোকরা আউট হয়ে। এত তাড়াতাড়িই জ্ঞান ফিরে পেয়ে কি করে এতদূর এসে হাজির হলো ভেবে একটু অবাকই হলো সে। অবশ্য, জানা আছে রানার, নেশার চরম পর্যায়ে যারা চলে যায় তারা অনেক সময় অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত জ্ঞান ফিরে পায়, পেয়েই পাগল হয়ে যায় আবার নেশা করবার জন্যে। আপাতত একে নিয়ে কোন সমস্যা নেই। পা বাড়াল সে সামনে।