অন্যান্য সবকিছুই জানতে, শুধু জানতে না যার পালিয়ে যাবার সুবিধের জন্যে দরজার সামনে পথ আটকাতে হবে আমার, সেই লোকের ওপর ইসমাইলকে হত্যার নির্দেশ ছিল। হয়তো সত্যিই তাই। তোমাকে কোন দোষ দিতে চাই না আমি, বিট্রিক্স। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্যে অনেককে। দেখেছি আমি দুনিয়ার অনেক ক্ষতি করতে। তবে তোমার ভালর জন্যেই একটা কথা বলব ভাল করে ভেবে দেখো, তোমার জীবন পড়ে রয়েছে। সামনে। মস্তবড় বিপদের মধ্যে রয়েছ তুমি। হেনরীর কথা ভেবে কোন লাভ নেই এখন, জীবন বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই ওর–তোমার নিজের কথাই অনেক বেশি করে ভাবা দরকার তোমার এখন।
কিছুই করবার নেই আমার, কিছুই বলবার নেই, দুহাতে মুখ ঢেকে রেখে মাথা নাড়ল সে। দয়া করে আপনি যান।
রানা বুঝল, এর পরে ওরও আর কিছুই করবার বা বলবার নেই কিছুতেই জবান খুলবে না আতঙ্কিত মেয়েটা–কাজেই দ্বিরুক্তি না করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
.
ঠিক একটা পাঁচে সোহানা আর মারিয়ার হোটেল কক্ষের অ্যাটাচড বাথরূম। থেকে বেরিয়ে এল প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা মাসুদ রানা। হাতের তোয়ালেটায়। বিশ্রী রকম ছোপ ছোপ দাগ লেগে গেছে মেকাপ তুলতে গিয়ে। বাথরূমের। আয়নায় মোটামুটি নিজের চেহারাটা পরিচিত ঠেকতেই বেরিয়ে এসেছে সে, ঘাড়ে, গলায় এখনও কিছু রঙ লেগে রয়েছে, কিন্তু সেগুলো ঢেকেঢুকে কোনমতে কার্লটনের ছশো বাইশ নম্বর কামরায় ঢুকতে পারলেই চলবে আপাতত।
খাটের ওপর সোজা হয়ে বসে আছে সোহানা ও মারিয়া, দুজনেই এমন নাইট-ড্রেস পরেছে যে সেগুলোকে মশারী না বলে ড্রেস কেন বলে, কিংবা প্রস্তুতকারক কি পরিমাণ কাপড় বাঁচিয়েছে এগুলো থেকে, ইত্যাদি নিয়ে একটা থিসিস লিখে ফেলা যায়। কিন্তু আপাতত হাতে সময় নেই বলে কলারের কাছে লালচে হয়ে যাওয়া শার্টটা গায়ে চড়িয়ে বোতাম লাগাতে শুরু করল সে দ্রুত হাতে।
তাহলে বেশির ভাগ নাইট-ক্লাবের মেয়েই ওই হোস্টেল প্যারিসে থাকে?
তাই তো মনে হলো। যে চারটে দলকে অনুসরণ করলাম, প্রত্যেকটাই ঢুকল গিয়ে হোস্টেল প্যারিসে। আরও কয়েকটা মেয়েকে ঢুকতে দেখেছি আমরা ওই হোস্টেলে–মনে হলো ওরাও ফিরছে নাইট-ক্লাব থেকেই।
একটা মুখও চিনতে পারলে না?
চেনা চেনা লেগেছে এক আধটা মুখ, কিন্তু শিওর হতে পারিনি। তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
হেনরী এবং বিট্রিক্সের কথা বলল রানা।
এত সময় লেগে গেল ওদের ওখানে?
না। আরও দুএকটা জায়গায় গিয়েছি। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। বিট্রিক্স শেরম্যানের ওখান থেকে বেরিয়ে আবার যে সে গিয়েছিল ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে সেকথা চেপে গেল রানা। গলার স্বর পাল্টে নিয়ে বলল, এবার তোমাদের কিছু কাজ দেয়া যাক। অযথা নাইট-ক্লাবে ঘোরাঘুরি রেখে এবার সত্যিকার কিছু কাজ দেখাও দেখি? বিনা দ্বিধায় রানাকে এই ধরনের একটা কথা বলতে দেখে রেগে উঠতে যাচ্ছিল মারিয়া, চট করে সোহানার মুখের দিকে চাইল, তারপর হাসল। রানা বলেই চলল, মারিয়া কাল সকালে যাবে ভন্ডেল পার্কে। রোজ সকালে যায় ওখানে ইরিন। ওর ওপর লক্ষ রাখতে হবে। কিন্তু সাবধান…ও চেনে তোমাকে। পার্কে গিয়ে ও কি করে, কারও সঙ্গে দেখা করে কিনা, কথা বলে কিনা, ইত্যাদির রিপোর্ট চাই আমি কাল। পার্কটা বিরাট, কিন্তু ওকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না; পুতুলের পোশাক পরা। এক বুড়ি থাকবে ওর সঙ্গে; সে বুড়ির পেটের বেড় হবে কমপক্ষে নয় ফিট। আর সোহানা, কাল ওই হোস্টেলের ওপর নজর রাখবে তুমি। যদি চার্চের কোন সন্ন্যাসিনীকে পাও ওদের মধ্যে, পিছু নেবে; কোথায় যায়, কি করে তার পূর্ণ বিবরণ চাই আমার। ভেজা, স্যাৎসেতে কোটটা গায়ে চড়াল রানা। চলি, গুডনাইট।
ত্রিশ গজ দূরে পার্ক করে রাখা ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠল রানা। ভাবল, আজ অন্ধকারে অনেকগুলো ঢিল ছুঁড়েছে সে। এর মধ্যে একটাও কি লাগবে না। ওদের ভীমরুল চাকে? কখন টের পাওয়া যাবে প্রতিক্রিয়া?
.
১০.
হোটেলে ফিরে দেখল রানা চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। ফুটপাথের ব্যারেল অর্গান বাদক এবং তার ভক্তবৃন্দ কেউ নেই। পোর্টার নেই, ডোরম্যান নেই। একটু অবাক হলো রানা-গেল কোথায় সব? হাত বাড়িয়ে। আলগোছে হুক থেকে চাবিটা খসিয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল সে দোতলায়, তারপর বোতাম টিপল লিফটের জন্যে।
ভেজা কাপড় সব খুলে ফেলে গরম পানিতে ভিজল রানা দশ মিনিট। তারপর শুকনো কাপড় পরে নিয়ে একটা সিগারেট ধ্বংস করল ব্যালকনির রেলিঙে হেলান দিয়ে। নিচের রাস্তায় লোক চলাচল অনেক কমে গেছে। কর্তব্য স্থির করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে ঘরে তালা মেরে।
খটাং করে চাবিটা রাখল রানা ডেকের ওপর। চমকে সোজা হয়ে বসে চোখ মিটমিট করল ঝিমন্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। রানাকে দেখে চট করে। চোখ গেল ওর দেয়াল ঘড়ির দিকে, তারপর ডেস্কের ওপর চাবির দিকে।
মিস্টার মাসুদ রানা। কখন, কখন ফিরলেন, দেখিনি তো?
অনেক আগে, বলল রানা। দুতিনঘণ্টা তো হবেই। বেঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন আপনি তখন। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন দুগ্ধপোষ্য শিশু…
ওর দৃষ্টিটা চট করে ঘুরে এল আর একবার ঘড়ির ওপর থেকে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, এখন কি আবার বেরোচ্ছেন কোথাও? রাত আড়াইটা!