কয়েক মিনিটের মধ্যেই দূরত্বটা বিশফুটের মধ্যে নিয়ে এল রানা। রেমব্র্যান্টপ্লেইনের দিকে এগোচ্ছে মেয়েটা, বেশ কিছুদূর গিয়ে থামল একটা ছোট্ট কাফের সামনে। কাফের বাইরে ফুটপাথের ওপর একটা ব্যারেল অর্গান। বাজাচ্ছে এক বুড়ো। চট করে রানার মনে পড়ল, কার্লটন হোটেলের বাইরেও এই রকম এক বুড়োকে দেখেছে সে ব্যারেল অর্গান বাজাতে। তবে সে লোকের দাড়ি ছিল। তার অবশ্য শ্রোতার সংখ্যাও এর চেয়ে বেশি ছিল-এর সামনে অর্গানের গায়ে হেলান দিয়ে মগ্ন হয়ে বেসুরো বাজনাঃগুনছে একটি মাত্র ছোকরা। একটু কাছে এগিয়ে পরিচিত ঠেকল রানার ছোকরার চেহারা। মনে হলো, দাড়িওয়ালা বুড়োর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে সে এই ছোকরাটাকে। একেবারে শুকনো, গালবসা, রুগ্ন চেহারা–অর্গানের গায়ে হেলান না দিলে দাঁড়িয়ে থাকবার সাধ্য ছিল না ওর। হঠাৎ হঠাৎ শিউরে উঠছে ছোকরার সর্বশরীর। অর্গান শিল্পী যে ছোকরাকে তেমন পছন্দ করতে পারছে না, বোঝা যাচ্ছে ওর বিরক্ত দৃষ্টি দেখে। বিরক্তি, সেই সঙ্গে ভয়। মাঝে মাঝে চারপাশে চাইছে বুড়ো ভীত চকিত দৃষ্টিতে।
অর্গানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল বিট্রিক্স। একটা টুপি তুলে ধরল বৃদ্ধ, তারমধ্যে একটা কয়েন ছেড়ে দিয়ে ছোকরার হাত ধরে টানল মেয়েটা। সোজা হয়ে দাঁড়াল ছোকরা। বিস্ফারিত চোখে চাইল বিট্রিক্সের দিকে। গালদুটো এতই বসা যে মনে হয় একটা দাঁতও নেই ওর। ঢাকার ফুটপাথে মরে পড়ে থাকা দুর্ভিক্ষের লাশ মনে হচ্ছে ওকে দেখে। বিট্রিক্সের ওপর ভর দিয়ে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেলে।
কাছে চলে এল রানা। বিনা বাক্যব্যয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরল ছোকরার পিঠ–মনে হলো যেন কঙ্কাল জড়িয়ে ধরেছে সে। কিন্তু এই সাহায্যে খুশি হলো না বিট্রিক্স, ওর চোখের দৃষ্টিতে উদ্বেগ আর ভীতি দেখতে পেল রানা।
প্লীজ! মিনতি ফুটে উঠল মেয়েটার গলায়। সাহায্য লাগবে না। আমিই পারব। দয়া করে ছেড়ে দিন ওকে।
তুমি পারবে না, মিস শেরম্যান। একসঙ্গে পড়বে দুজন ড্রেনের মধ্যে।
হতবুদ্ধি বিট্রিক্স যেন কিছুই বুঝতে পারল না কয়েক সেকেন্ড, তারপর অস্ফুট গলায় বলল, মিস্টার মাসুদ রানা!
এটা কিন্তু বড়ই অন্যায় কথা, অনুযোগের কণ্ঠে বলল রানা। এত সুন্দর চেহারা আমার, সেই চেহারাটা চিনতে পারলে না তুমি দুঘন্টা আগে, নামই মনে করতে পারলে না–আর যেই ছদ্মবেশ নিলাম, অমনি ডেকে উঠলে নাম ধরে।
হঠাৎ হাল ছেড়ে দিল ছোকরা, পা ভাঁজ হয়ে পড়ে যাচ্ছিল রানার হাত ফসকে, চট করে ধরে ফেলল রানা আবার। এভাবে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে বেশিদূর যাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে নিচু হয়ে ওকে কাঁধে তুলে নেয়ার। উপক্রম করল সে। খপ করে হাত ধরল মেয়েটা রানার। আতঙ্কিত চোখমুখ।
না, না! ওভাবে তুলবেন না ওকে! প্লীজ!
কেন? এভাবেই তো সহজ হবে।
না, না! পুলিস দেখলে ধরে নিয়ে যাবে ওকে।
সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল রানা, এক হাতে ওর পিঠ জড়িয়ে ধরে খাড়া রাখবার চেষ্টা করল যতটা সম্ভব, পা বাড়াল সামনে। বলল, ফাঁদে পড়ে গেছ শিকারীর। সামনে এখন শুধু অন্ধকার।
রানার বক্তব্য পরিষ্কার বুঝতে না পেরে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল মেয়েটা ওর মুখের দিকে।
হেনরীর জন্যে তোমাকে…
হেনরী! ওর নাম জানলেন কি করে আপনি?
গোপন খবর জানাই তো আমার কাজ, বলল রানা হাসিমুখে। যা বলছিলাম। পুলিসের কাছে ও যদি অপরিচিত হত, তবু এক কথা ছিল। কিন্তু। জেল খাটা দাগী ভাই যদি নেশার খপ্পরে পড়ে তাহলে সত্যিই খুবই অসুবিধের কথা। সমাজে মাথা উঁচু করে চলা মুশকিল হয়ে যায়।
কোন উত্তর দিল না মেয়েটা। পরাজিত, পাংশু মুখে হাঁটছে সে মাথা নিচু করে। চেহারায় হতাশা আর বিভ্রান্তির স্পষ্ট ছাপ। রানার উপস্থিতি যে ওর উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ, রানাকে সহ্য করা যে ওর পক্ষে কতখানি। কঠিন বুঝতে পারল রানা পরিষ্কার। যদি কোন যাদুমন্ত্রের বলে মুহূর্তে নাই হয়ে যেত রানা, মস্ত হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে পারত হয়তো সে। কিন্তু হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না ওর মধ্যে।
থাকে কোথায় ও? জিজ্ঞেস করল রানা।
আমার সঙ্গেই। ব্যাপারটা রানার জানা নেই বলে যেন একটু বিস্মিত হয়েছে সে। কাছেই। বেশি দূরে না।
ব্যালিনোভা ছাড়িয়ে একটা সরু গলি দিয়ে গজ পঞ্চাশেক গিয়েই পৌঁছে গেল ওরা অ্যাপার্টমেন্ট হাউজের সামনে। হেনরীকে কাঁধে নিয়ে সরু সিঁড়ি দিয়ে বহু কষ্টে তেতলায় উঠল রানা বিট্রিক্সের পিছু পিছু। দরজা খুলে দিতেই ঢুকল ভিতরে। বাথরূমের সমান দুটো ঘর–একটা বসবার একটা শোবার। বসবার ঘর পেরিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকল রানা, খাটের ওপর কঙ্কালটা শুইয়ে দিয়ে ঘাম মুছল কপালের। চলে এল বসবার ঘরে।
এই সিঁড়ি দিয়ে রোজ ওকে নিয়ে ওঠো কি করে? মই বেয়ে ওঠাও তো এর চেয়ে সহজ।
কি করব… গার্লস হোস্টেল এর চেয়ে অনেক ভাল, সস্তাও, কিন্তু হেনরীকে নিয়ে..নাইট-ক্লাব থেকে বেশি পয়সা দেয় না আমাকে।
ঘরের চারপাশে চাইল রানা। আসবাবের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে। খুবই কম দেয়। বলল, তোমার মত কলে পড়া ইঁদুরকে কিছু যে দেয়, এই তো বেশি।
তার মানে?
মানেটা ভাল করেই জানা আছে তোমার। ফাঁদে আটকা পড়ে হাঁসফাস করছ, অথচ মানে বুঝতে পারছ না, এটা হতেই পারে না, বিট্রিক্স।