কেউ কোন জবাব দিল না। দর্শকদের চিৎকারে তিনজনই চাইল স্টেজের দিকে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নর্তকী এখন গরিলার হাত থেকে বাঁচবার জন্যে। ধরে ফেলে ফেলে, এমনি অবস্থায় হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, চেঁচিয়ে উঠছে ভয়ে, দমাদম বুক পিটছে গরিলা, আবার চেষ্টা করছে ওকে ধরতে। ড্রামের দ্রুত ছন্দ নেশা ধরিয়ে দিয়েছে, নাচন শুরু হয়ে গেছে। দর্শকদের রক্তে। তালে তালে শরীর ঝাঁকাচ্ছে সবাই, পৈশাচিক আনন্দ লাভ করছে ওদের ধর্ষণকামী প্রবৃত্তি। হঠাৎ প্রচণ্ড এক আওয়াজ করে থেমে গেল। ড্রাম। লোমশ বুকের ওপর চেপে ধরেছে গরিলা যুবতাঁকে। ছটফট করছে মেয়েটা ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে। চিৎকার করে উঠল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে। টানাহেঁচড়ায় সরু ফিতে দিয়ে বাধা নক্ষত্রদুটো খসে গেল ওর বুক থেকে। মাথার ওপর তুলে নিয়েছে বিকট গরিলা যুবতাঁকে, বিজয়গর্বে মুরল কয়েক পাক, তারপর শুইয়ে দিল ওর জ্ঞানহীন দেহটা মেঝের ওপর। মাথাটা একপাশে হেলে রয়েছে যুবতীর। নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ল গরিলাটা যুবতীর জ্ঞানহীন নগ্ন শরীরের ওপর। দপ করে নিভে গেল সব কটা স্পট লাইট। কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা। শুধু দর্শকদের উত্তেজিত শ্বাস শোনা যাচ্ছে। পর মুহূর্তে বিকট হৈচৈ আর হাততালিতে ফেটে পড়ল দর্শকবৃন্দ।
এবার আমাদের কাজ কি? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।
শহরে যে কটা নাইট-ক্লাব আছে, সবগুলোতে একবার করে ঢুঁ দিতে হবে তোমাদের। খুঁজে দেখবে, চেনা কোন মুখ পাওয়া যায় কিনা। নর্তকী, ওয়েট্রেস বা দর্শকদের মধ্যে কাউকে চিনতে পারো কিনা দেখো।
নাইট-কাবে সন্ন্যাসিনী? চোখ কপালে উঠল সোহানার।
কেন নয়? ওদের মানুষ বলে গণ্য করো না বুঝি? হাসল রানা। বিশেষ করে যাদের দেখবে লম্বা-হাতা জামা, কিংবা কনুই পর্যন্ত লম্বা গ্লাভ তাদেরকে লক্ষ্য করবে ভাল মত। গির্জার কাউকে যদি পেয়ে যাও, তাহলে সে কোথায় থাকে বের করার চেষ্টা করবে। কিন্তু যা-ই করো না কেন, রাত একটার মধ্যে ফিরে যাবে নিজেদের হোটেলে। ওখানে দেখা করব আমি তোমাদের সঙ্গে।
ইতিমধ্যে কোথায় কি কাজ তোমার?
কাজের অভাব নেই। প্রচুর কাজ পড়ে রয়েছে আমার সামনে এখন। কোনটা ছেড়ে কোটা বলি?
অর্থাৎ বলবে না।
হলুদ একটা স্পট লাইট জ্বলে উঠল শূন্য স্টেজের ওপর। নিগ্রো ড্রমবাদক একলাফে অন্ধকার থেকে এসে দাঁড়াল আলোয়, লম্বা করে কুর্নিশ করল দর্শকদের। কুর্নিশরত অবস্থাতেই হ্যাঁচকা টান দিল সে নিজের কোকড়া চুল ধরে। চুলসহ একটা পাতলা রবারের মুখোশ খসে এল ওর হাতে–বেরিয়ে পড়ল লালচুলো এক ধবধবে ফর্সা যুবকের মুখ। প্রচুর হাততালি পড়ল, সেই সঙ্গে সিটি। আরেকবার বো করে একপাশে সরে দাঁড়াল ড্রামরাদক। দৌড়ে এসে দাঁড়াল নর্তকী, বো করতে গিয়ে নিজের বুকের দিকে চোখ পড়তেই জিভ কাটল আধ হাত। চকচকে নক্ষত্র লাগাতে ভুলে গেছে। লজ্জিত হাসি হাসল মেয়েটা, তারপর একহাতে বুক ধরলো, আরেক হাতে চুল–জোরে টান দিতেই খসে এল দুটোই। দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে যোলো-সতেরো বছরের। এক ছোকরা। প্রথমে বিস্মিত গুঞ্জরন, পরমুহূর্তে প্রচুর হাততালি পড়ল। এবার তড়াক করে স্টেজে উঠে এল গরিলাটা। কুৎসিত ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ ঘুরে। বারকয়েক কুর্নিশ করে লোমশ দুই হাতে ধরল নিজের মাথাটা। কাঁধ থেকে। নিয়ে ওপরের অংশটা খসে এল ওর হাতে। মাথাটা ঝাড়া দিতেই একরাশ সোনালী চুল ছড়িয়ে পড়ল গরিলার লোমশ কালো পিঠে। মেয়ে একটা। হাসছে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখে। তুমুল হর্ষধ্বনি।
বাঁকা হাসি খেলে গেল সোহানার ঠোঁটে। বলল, কী সুক্ষ্ম রসবোধ, তাই? উঠে দাঁড়াল। চলো, মারিয়া, অন্যান্য নাইট-ক্লাবগুলোও নিশ্চয়ই শিল্প চেতনা আর সৌন্দর্য বোধের ব্যাপারে এদের চেয়ে কম যাবে না। দেরি হলে মিস্ করব আবার।
বেরিয়ে গেল ওরা। কেউ ওদের অনুসরণ করে কিনা দেখবার জন্যে আড়চোখে চেয়ে রইল রানা ওদের গমন পথের দিকে। মস্ত মোটা এক দয়ালু চেহারার লোক পিছু নিল ওদের। এতই মোটা যে থুতনির তিনভাজ চলে এসেছে একেবারে বুক পর্যন্ত, গলা বা ঘাড়ের কোন অস্তিত্বই নেই। মোটা লোকটার পিছু নেয়াটা অনুসরণ কিনা ঠিক বোঝা গেল না, কারণ, কয়েক ডজন লোক আবার পিছু নিল মোটার। আজ রাতের আসল আকর্ষণ শেষ, দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে ঘরটা। দেখতে দেখতে অর্ধেক টেবিলই খালি হয়ে গেল। হালকা হয়ে যাচ্ছে ধোয়ার আস্তরণ। ব্যস্তপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওয়েটাররা। একটা নির্জলা স্কচ হুইস্কির অর্ডার দিল রানা। যা নিয়ে আসা হলো, এক চুমুক খেয়েই বুঝতে পারল সে, কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করলে হয়তো এর মধ্যে সামান্য একটু হুইস্কির ছিটেফোঁটা আবিষ্কার করা যেতে। পারে-না-ও যেতে পারে। নির্জলা হুইস্কি নয়, নিহুইস্কি জল। পয়সা লুটবার কোন দিকই আর বাদ রাখেনি এরা। বুড়ো এক লোক নিবিষ্টচিত্তে ভেজা এক ন্যাকড়া দিয়ে মুছছে ডান্সফ্লোরটা।
ভিতর দিকের একটা খোলা দরজার সামনে দেখতে পেল রানা বিট্রিক্স শেরম্যানকে। একটা শাল জড়াচ্ছে কাঁধে, পাশেই আর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। কি যেন ফিসফিস করে বলছে ওর কানে কানে। দুজনের উত্তেজিত, ব্যস্তসমস্ত হাবভাব দেখে মনে হলো অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ কিছু ঘটেছে। বারকয়েক মাখা। ঝাঁকাল বিট্রিক্স, চারপাশে চাইল সতর্ক দৃষ্টিতে, তারপর লম্বা পা ফেলে। বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। যেন তাড়া নেই রানার, ধীরে সুস্থে বিল চুকিয়ে। দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে-ও বাইরে।