দপ করে জ্বলে উঠল একটা গোলাপী আলো। দেখা গেল স্টেজের এক। কোণে পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধবধবে ফর্সা এক যুবতী, এক ইঞ্চি আকৃতির গোটা দুই চকচকে তারা দিয়ে বুক ঢাকা, কোমর থেকে ঝুলছে আধ। হাত লম্বা একটা ঝাঁকিজাল। নাচতে শুরু করল যুবতী দুলে দুলে, প্রতিটা স্টেপিঙের সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে বুক। দুলছে কোমর, যেন ঢেউ উঠছে। ভূমধ্যসাগরে। স্পট লাইটের আলোয় দেখা গেল মেয়েটার পেছনে আবছামত দেখা যাচ্ছে সবুজ পাতা দিয়ে ছাওয়া একটা বড়সড় বাঁশের খাঁচা।
চারপাশে চেয়ে দেখল রানা। পুরুষের সংখ্যাই বেশি। তবে মেয়েও। নেহায়েত কম নেই। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে দর্শকবৃন্দ নর্তকীর দিকে। ছন্দের গতি বাড়ছে ক্রমে। সাথে সাথে বাড়ছে দর্শকদের হৃৎপিণ্ডের গতি। বেশির ভাগেরই তেরো থেকে পচিশের মধ্যে বয়স, তবে মাঝবয়সী বা.বৃদ্ধও যে একেবারে নেই তা নয়। সবাই সমভাবেই উপভোগ করছে যুবতীর উদ্দাম নৃত্য। দর্শকমণ্ডলীর পোশাক দেখে সচ্ছলতার আভাস পেল রানা। নাইটক্লাব অবশ্য সব দেশেই ধনীদের জন্যে, তবে এটা দেখে মনে হচ্ছে এর চাকচিক্য যেন কয়েক ডিগ্রী চড়া-অ্যামস্টার্ডামের সেরা নাইট-ক্লাবগুলোর মধ্যে এটা যে অন্যতম তাতে কোন সন্দেহ নেই। দরজার কাছাকাছি একটা। টেবিলে এসে থামল রানার দৃষ্টি। বসে আছে মারিয়া আর সোহানা। এমন ভঙ্গিতে, যে ওদের মনের সাথে যে এই ক্লাবের মূল সুরের মিল নেই, বোঝ যাচ্ছে পরিষ্কার। কেমন একটা নিঃসঙ্গ, ছাড়াছাড়া দায়িত্বপালনের ভাব।
ছদ্মবেশের কোন প্রয়োজন ছিল বলে মনে হলো না রানার। কেউ খেয়ালই করল না ওর উপস্থিতি। ছন্দের সাথে সাথে বাড়ছে উত্তেজনা হাতের গ্লাসগুলো এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে সবাই, মনে হচ্ছে ভেঙে ফেলবার চেষ্টা করছে। স্বর্ণকেশী সুন্দরী স্টেজের ওপর কিলবিল করছে মেরুদণ্ডবিহীন গোলাপী সাপের মত। বাশের খাঁচাটার একটা অংশ খুলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে। নীল একটা কম পাওয়ারের স্পট লাইট জ্বলে উঠেছে। কি যেন নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে খাঁচার মধ্যে।
সোহানা আর মারিয়া যে টেবিলে বসে আছে, ঠিক তার পাশের টেবিলে। বসল রানা একটা চেয়ার টেনে। সোহানার এতই গায়ের কাছে বসল যে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল সে রানার মুখের দিকে। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে উজ্জল একটা হাসি উপহার দিল রানা সোহানাকে। চমকে উঠল সোহানা রানার হাসি দেখে, চট করে সরে সরে গেল ছয় ইঞ্চি।
ভয় কি? বড়জোর অশ্লীল কোন প্রস্তাব দিতে পারি, খেয়ে তো আর ফেলব না? বলল রানা হাসিমুখে। আবার চমকে উঠল সোহানা। এবার ওর সাথে মারিয়াও। ভুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে ওরা রানার মুখের দিকে।
কি ব্যাপার? বেশ কিছুক্ষণ পর কিছুটা সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল সোহানা, তোমার মুখের জিওগ্রাফি পাল্টে দিল কে?
কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড। মাসুদ রানা দি গ্রেট এখন ছদ্মবেশে। অত জোরে চেঁচিয়ো না, গলাটা নামাও।
কিন্তু… কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এখানে পৌঁছলেন কি করে? জিজ্ঞেস করল মারিয়া। দুই মিনিটও হয়নি এই ঠিকানা জানিয়ে ফোন করেছি আমি, আমাদের হোটেলে।
অন্য সোর্স থেকে খবর পেয়ে এসেছি আমি এখানে। গির্জা থেকে সোজা এখানে এসে ঢুকেছে শেরম্যান? সহজ গলায় কথা বলো, ফিসফিস করবার দরকার নেই।
গলা দিয়ে আওয়াজ বের করল না কেউ, মাথা ঝাঁকাল দুজন একসাথে।
বেরিয়ে যায়নি এখান থেকে?
সদর দরজা দিয়ে বেরোয়নি। স্টেজের পাশে একটা বন্ধ দরজার দিকে চাইল সোহানা। ওই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে মিনিট পাঁচেক হলো।
দরজাটার দিকে চাইল রানা। চট করে চোখ গেল স্টেজের দিকে। নীল স্পট লাইনের আলোটা জোরদার হচ্ছে ক্রমে। কালো, লোমশ, বিশাল, বিকট একটা মুর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বাঁশের খাঁচার একটা অংশ। খুলে গেছে–খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসছে মস্ত এক গরিলা, ঝকঝক করছে। ভয়ঙ্কর সাদা দাঁত, হাতদুটো ঝুলছে হাটুর কাছে। আরও দুই পা এগোতেই পরিষ্কার দেখা গেল পুরুষ গরিলা। যদিও সবাই জানে ওটা গরিলার খোলস। পরা মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়, তবু ভয়ে চিৎকার করে উঠল কয়েকজন। নিগ্রোটা তাল বাড়িয়ে দিয়েছে আরও, পাগলের মত বাজিয়ে চলেছে সারা শরীরে কাঁপন তুলে। মেয়েটা যেন টেরই পায়নি যে পিছন থেকে ভীষণ এক গরিলা এগিয়ে আসছে, আপন মনে নেচে চলেছে সে উদ্দাম অশ্লীল নাচ–এমন সব অঙ্গভঙ্গি করছে যে নিজের অজান্তেই কুঁচকে উঠছে সোহানার নাক।
গির্জার নানগুলোর চেহারা মনে রাখতে বলেছিলাম, রেখেছ?
চেষ্টা করেছি, বলল মারিয়া।
অদ্ভুত, বিসদৃশ বা ওই রকম কিছু চোখে পড়েছে তোমাদের কারও?
তেমন কিছু না, বলল সোহানা। তবে ওখানকার সন্ন্যাসিনী প্রত্যেকেই দেখতে ভাল।
আগেই শুনেছি খবরটা মারিয়ার কাছে। আর কিছু চোখে পড়েনি?
দুজন দুজনের দিকে চাইল, একটু ইতস্তত করে মারিয়া বলল, একটা ব্যাপার একটু অবাক লেগেছে আমার কাছে। গির্জায় ঢুকল অনেক বেশি লোক, বেরোল কম।
তার মানে?
ঠিকই বলছে মারিয়া,বলল এবার সোহানা। প্রার্থনার সময় যত লোক দেখেছিলাম, বের হলো অনেক কম।
অনেক বলতে কি বোঝাতে চাইছ?
একটু ইতস্তত করে সোহানা বলল, মানে… বেশ কিছু।
বা বা! অনেক থেকে এক লাফে চলে এলে বেশ কিছুতে। এরপর আরেক লাফে শূন্যতে নেমে যাবে মনে হচ্ছে? যাই হোক তোমাদের মনে। হচ্ছে, গির্জায় যত লোক ছিল সবাই, বেরোয়নি, এই তো? কেউ কেউ ব্যক্তিগত প্রার্থনার জন্যে থেকে যেতে পারে। খুব একটা অবাক হওয়ার কি আছে এতে?