এই বার? কি বুঝছেন?
বুঝতে পারছি, এই নাইট-ক্লাবের সাথে সম্পর্ক ছিল কার্লটন হোটেলের সাততলার ফ্লোর ওয়েটারের।
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল কর্নেল রানার মুখের দিকে। বুঝতে পেরেছে, নম্বরগুলো কার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল রানা, কিভাবে সংগ্রহ করেছিল সেটাও আঁচ করে নিতে অসুবিধে হলো না তার। পনেরো সেকেন্ড পর ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল কর্নেল। বড় বিপজ্জনক খেলায় নেমেছেন, মেজর মাসুদ রানা।
উঠে দাঁড়াল রানা। হাত বুলাল নিজের গালে। অনেক লোকেরই চেনা। হয়ে গেছে মুখটা। ছদ্মবেশের কিছু মালমশলা পাওয়া যাবে না, আপনাদের। হেডকোয়ার্টারে?
ছদ্মবেশ! চোখ মিটমিট করল কর্নেল। হেসে ফেলল। ওহ্ নো! এই যুগে? শার্লক হোমস মারা যাওয়ার এত বছর পরেও?
শার্লক হোমসের অর্ধেক বুদ্ধি যদি থাকত আমার মাথায়, তাহলে ছদ্মবেশের কোন প্রয়োজনই পড়ত না। কথাটা বলল রানা এমন সুরে, যাতে শ্রোতার বিশ্বাস উৎপাদন করা যায়। কিন্তু এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে। এছাড়া আর কোন গত্যন্তর দেখতে পাচ্ছি না।
অল রাইট, বলল কর্নেল। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
দরকারটা আমার এক্ষুণি।
বিশাল শরীরটা টেনে তুলল কর্নেল চেয়ার থেকে।
বেশ। আসুন আমার সঙ্গে।
.
০৯.
সত্যিই, বাইরে থেকে দেখতে অবিকল একটা ট্যাক্সিই। ওপেল। কিন্তু গাড়িটার স্পীড দেখে রীতিমত খুশি হয়ে উঠল রানা। দারুণ এক এঞ্জিন লাগিয়ে প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এর শক্তি। এছাড়াও আরও কিছু। কারিগরী রয়েছে এর মধ্যে। সাইরেনের ব্যবস্থা তো আছেই, একটা বোতাম টিপলে একখানা আনরেকেবল ফাঁইবার গ্লাসের শীট নেমে আসে ছাত থেকে, মুহর্তে আলাদা হয়ে যায় গাড়িটা দুটো কম্পার্টমেন্টে-পেছনের আরোহীর। সঙ্গে চোখের দেখা ছাড়া আর কোন সম্পর্ক থাকে না ডাইভারের। আরেকটা বোতাম টিপলে ছাতের একটা অংশ খুলে মাথা তুলবে পুলিস লাইট। আরেকটা টিপলে পেছনের একটা প্যানেলে ফুটে উঠবে উজ্জ্বল লেখা-স্টপ! প্যাসেঞ্জার সীটের তলায়–অর্থাৎ, ড্রাইভারের পাশের সীটের নিচে রয়েছে। পাকানো রশি, ফাস্ট-এইড কিট, টিয়ার গ্যাস-ক্যানিস্টার। দরজার পকেটে রয়েছে একজোড়া হ্যাঁন্ডকাফ, সেই সঙ্গে চাবি। পেছনের বুটে যে আরও কত কি কৌশল রয়েছে জানাবার চেষ্টা করেছিল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড, কিন্তু শুনতে চায়নি রানা, মাথা নেড়ে বলেছে ওসব আমার কোন কাজে লাগবে না কর্নেল, গাড়িটা জোরে চলে কিনা সেটাই আসল কথা।
ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাবের কাছেই নো পার্কিং লেখা একটা জায়গায়। গাড়িটা রাখল রানা রাস্তার অপর পাড়ে দাঁড়ানো এক ইউনিফর্ম পরা। কনস্টেবলের ঠিক নাক বরাবর। তিন সেকেন্ড গাড়িটার দিকে চেয়ে থেকে সামান্য একটু মাথা ঝাঁকাল কনস্টেবল, তারপর মর্যাদার সাথে দূরে সরে গেল হাঁটতে হাঁটতে। রানা বুঝল, পুলিসের গাড়ি চিনতে অসুবিধে হয়নি কনস্টেবলের; কেউ যদি প্রশ্ন করে যেখানে পার্ক করলে সবার গাড়িতেই হলুদ টিকেট সেটে দেয়া হয়, ঠিক সেই জায়গায় তোমার চোখের সামনে পার্ক করল একটা ট্যাক্সি, আর তুমি দেখেও দেখলে না কোন বিশেষ কারণে, ঘুষটুষ খেয়েছে নাকি কোন উত্তর দিতে পারবে না সে; কাজেই মানে মানে কেটে পড়ল লোকটা।
গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রানা, দরজায় লক করে এগোল ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাবের দিকে। ছোট্ট একটা নিয়ন সাইনে নাম লেখা, নামের দুইপাশে। দুজন প্রায়-উলঙ্গ নর্তকীর ফিগার আউটলাইন–জ্বলছে, নিভছে। সুইংডোরের দুইপাশে খানিকটা করে জায়গা কাঁচটাকা, অনেকগুলো পেইন্টিং আর। ফটোগ্রাফ সাজানো রয়েছে সেখানে আট এগজিবিশনের কায়দায়। এগুলোর। দিকে একনজর চাইলেই ভিতরে কি ধরনের সৌন্দর্যচর্চা চলেছে বুঝতে অসুবিধে হয় না। সবগুলোই মেয়েমানুষের ছবি। কোন কোনটায় কানের দুল আর পায়ের হাইহিল জুতা ছাড়া আর কোন পোশাক পরিচ্ছদের বালাই নেই, এমন সব বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়ানো কিংবা বসা যে ওগুলোর দিকে দশ সেকেন্ড চেয়ে থাকলেই যৌবন ফিরে পাবে অশীতিপর বৃদ্ধ। কাঁচের গায়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল রানা। যদি জানা না থাকত ও কে, তাহলে চিনতেই পারত না সে নিজেকে। ঢুকে পড়ল ভিতরে।
বেশ বড়সড় একটা ঘর। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। বিদঘুটে গন্ধ এল রানার। নাকে অনেকটা রাবার-পোড়া মত। বুঝতে অসুবিধে হলো না রানার, স্বাভাবিক কোন কারণে তৈরি হচ্ছে না গন্ধটা-স্প্রে করা হচ্ছে ওটা কয়েক মিনিট পর পর। কেন? নিশ্চয়ই আরও কিছু গন্ধ ঢাকবার উদ্দেশ্যে? মনে মনে ওদের বুদ্ধির প্রশংসা করল রানা। এই বিশেষ গন্ধটির একমাত্র গুণ হচ্ছে কিছুতেই আর কোন গন্ধ নাকে আসবে না, কারও। ভাল। সারাটা ঘর মান আলোয় আলোকিত। ঘরের এককোণে ছোট্ট একটা স্টেজের একপাশে উদ্দাম ছন্দে একটা আফ্রিকান ড্রাম বাজাচ্ছে একজন পেশীবহুল, স্বাস্থ্যবান নিগ্রো, ঘন কালো কোঁকড়া চুল খাড়া হয়ে রয়েছে মাথার ওপর আধহাত। চকচকে, পিচ্ছিল, কালো শরীরে কাপড়চোপড়ের কোন বালাই নেই–কোমরের কাছে কিছু পাতা-টাতা বেঁধে লজ্জা নিবারণ করেছে (অবশ্য যদি লজ্জা বলে কিছু থেকে থাকে), গলায় বন্য জন্তুর দাঁত দিয়ে তৈরি মালা। বিদঘুটে ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, আর দমাদম ড্রাম পেটাচ্ছে লোকটা-স্পট লাইটের বেগুনী আলোয় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে, ওর অঙ্গভঙ্গি।