শেষ মাথায় পৌঁছে অপ্রস্তুত অবস্থায় হোঁচট খেলো নিষ্ঠুর চেহারার লোকটা, টাল সামলে নিয়ে দেখল পৌঁছে গেছে ওপারে। ঝট করে ঘুরেই দৌড়াতে শুরু করল সে। এতগুলো লোকের সামনে খুন করতে দ্বিধা হওয়াই স্বাভাবিক, তবে রানা বুঝতে পারল, সেই কারণে যে লোকটা রেহাই দিয়েছে তাকে তা নয়, প্রয়োজন মনে করলে কয়েক হাজার দর্শকের সামনেও খুন করতে পারবে এই নোক, আসলে রানাকে হত্যা করবার প্রয়োজন বোধ করেনি লোকটা। আবার ছুটতে শুরু করল রানা।
শরীরে খানিকটা বল ফিরে পেয়ে জোরে দৌড়ে কাছে চলে আসছিল। রানা, ইমিগ্রেশন অফিসারদের অবাক করে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল সামনের। লোকটা ওপাশের খোলা দরজা দিয়ে। সাধারণত লোকে ধীরস্থির ভাবে ঢেকে ইমিগ্রেশন হলে, অফিসারদের সামনে থেমে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট দেখায়, প্রশ্নের উত্তর দেয়-এটাই নিয়ম; দৌড়ে পেরিয়ে যায় না কেউ এই এলাকা। কিন্তু রানা আবার যখন ওদের অবাক করবার চেষ্টা করল ততক্ষণে হুশ ফিরে। পেয়ে সতর্ক হয়ে গেছে তারা। সাঁ করে একজন লোক বেরিয়ে চলে গেল, তার পিছু পিছু রক্তাক্ত চেহারায় আরেকজনকে ছুটতে দেখে থামাবার চেষ্টা, করল দুজন অফিসার রানাকে। এক ঝটকায় ওদের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে দরজার দিকে ছুটল রানা। কিন্তু কপালের ফেরে বাধা পড়ল ঠিক দরজার মুখেই।
ওপাশ থেকে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে একজন। একটা মেয়ে। ডানদিকে সরল রানা, মেয়েটা সরল বামদিকে; বামদিকে সরল রানা, মেয়েটা সরল ডানদিকে। ফুটপাথে প্রায়ই দেখা যায় এই ঘটনাসামনাসামনি পড়ে যেতেই একজন ভদ্রতা করে একপাশে সরে যায়, অপরজনও ভদ্রতার দিক। থেকে কম যায় না, সে-ও সঙ্গে সঙ্গে সরে পথ দিতে চেষ্টা করে, ফলে দেখা যায় আবার পথ আটকে দাঁড়িয়েছে দুজন দুজনের। অতি বিনয়ী দুজন মুখোমুখি পড়লে অনির্দিষ্টকালের জন্যে চলতে পারে এই ক্যারিক্যাচার। কিন্তু ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখবার মূডে নেই রানা এখন, মোটমাট বার তিনেক ডাইনে-বায়ে করে খপ করে মেয়েটার কাঁধ চেপে ধরে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল ওকে সামনে থেকে। মেয়েটা কিসের সাথে গিয়ে ধাক্কা খেলো, ব্যথা পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল। কেন, সে সব দেখবার প্রয়োজন বোধ করল না সে, ছুটল সামনের দিকে। পরে ফিরে এসে মাফটাফ চেয়ে নিলেই হবে।
খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসতে হলো রানাকে। দরজার গোড়ায় রানার কয়েক সেকেন্ড ভদ্রতার সুযোগ নিয়েছে সামনের লোকটা পুরোপুরিই। লোকের ভিড়ে মিশে গেছে বেমালুম। তিন মিনিট খোঁজাখুজি করে ফিরে এল হতাশ রানা। পরিষ্কার বুঝতে পারল, এখন এয়ারপোর্ট পুলিসের কাছে রিপোর্ট করে কোন লাভ নেই, যতক্ষণে সে নিজের পরিচয় দিয়ে এদের কাজে নামতে বাধ্য করবে, ততক্ষণে একেবারেই পগার পার হয়ে যাবে লোকটা। প্রফেশনাল কিলার তার পালাবার পথ প্রশস্ত রেখেই নামে কাজে। এইলোক যে প্রফেশনাল তাতে রানার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আপাতত এর পেছনে। আর সময় নষ্ট করবার কোন অর্থই হয় না। ইমিগ্রেশন হলে ফিরে এল সে। ভারী পায়ে। মাথার ভিতরটা দপ দপ করছে, বেশ খানিকটা ফুলে গেছে কপালের একপাশ, পেটে সেই তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাটা নেই, কিন্তু ব্যথা-ব্যথা একটা ভাব রয়েছে বলে গা-টা গুলাচ্ছে। ঘরে এসে ঢুকতেই ইউনিফর্ম পরা দুই পুলিস দুদিক থেকে ধরল রানার দুই হাত।
ভুল লোককে ধরেছ, বলল রানা। দয়া করে হাত সরাও। সরে দাঁড়াও–শ্বাস নিতে দাও আমাকে।
একটু ইতস্তত করে রানার হাত ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেল লো দুজন–প্রায় দুই ইঞ্চি দূরে। লম্বা করে দম নিয়ে মেয়েটার দিকে চাইল রানা। বাইশ-তেইশ বছর বয়স হবে, ঘন নীল রঙের কোট পরেছে, কোটের নিচে সাদা পোল-নেক জাম্পার। সুন্দরী। জুলফির কাছে খানিকটা কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে। রুমাল দিয়ে মুছছে। মেয়েটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একজন সুদর্শন। উচ্চপদস্থ এয়ারপোর্ট অফিশিয়াল-প্রশ্ন করছে ওকে, দেখে মনে হচ্ছে প্রেম। নিবেদন করছে।
ইয়াল্লা! বলল রানা। আমি ওই দশা করেছি বুঝি আপনার?
না, না, মোটেই না, চাপা ফ্যাসফেসে গলায় বলল মেয়েটা। আজ সকালে দাড়ি কামাতে গিয়ে কেটে ফেলেছি।
আমি সত্যিই দুঃখিত, দুঃখ দুঃখ চেহারা করল রানা। একটা খুনীকে তাড়া করছিলাম। খুন করে পালাচ্ছিল লোকটা। আপনি পড়ে গিয়েছিলেন আমার সামনে পালিয়ে গেল লোকটা, সেই সুযোগে।
আমার নাম মর্গেনস্টার্ন। এখানেই কাজ করি এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি। বলল মেয়েটার পাশে দাঁড়ানো লোকটা। চোখা চেহারা, বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, চেহারায় দায়িত্ববোধের ছাপ পড়েছে। খুনের খবরটা শুনেছি। খুবই দুঃখজনক। এই রকম একটা কাণ্ড শিফল এয়ারপোর্টে ঘটে যাবে, ভাবাই যায় না।
মাথা ঝাঁকাল রানা। বলল, আমার তো মনে হয় আপনাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করায় মৃত লোকটার লজ্জা পাওয়া উচিত।
এই ধরনের কথায় কারও কোন উপকার হয় না, মর্গেনস্টার্নের কণ্ঠে ভর্ৎসনার আভাস। মরা লোকটা আপনার পরিচিত?
কি করে হবে? এইমাত্র নেমেছি আমি প্লেন থেকে। বিশ্বাস না হয়। স্টুয়ার্ডেসকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। এখানকার কিছু চিনি না আমি একেবারে নতুন।
আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি আপনি। গম্ভীর কণ্ঠে বলল মর্গেনস্টার্ন। রানা, বুঝল, শুধু চেহারায় নয়, সবদিক থেকেই লোকটা চোখা।