আজ সন্ধ্যায় কোথায় গিয়েছিল, কি কি ঘটেছে, কিছুই বলেনি তোমাকে সোহানা?
বলবার সুযোগ পায়নি, বলল মারিয়া। ও যখন ফিরে আসে, আমি তখন। ঘুমে। রাস্তায় চলতে চলতে শুনছিলাম। সবিস্তারে। কিন্তু ও যখন সেই ভয়ঙ্কর গলিতে দাঁড়িয়ে আপনার কলার ধরে ঝাঁকাচ্ছে ঠিক সেই সময় গির্জার মধ্যে ঢুকে পড়ল সামনের মেয়েটা। ওল্ডবেলে ফিরে গিয়ে আপনাকে খবরটা জানাতে বলেই ঢুকে গেল সেও গির্জার মধ্যে।
হাত নেড়ে একটা ট্যাক্সি ডাকল রানা। দশ মিনিট পর একটা গলির মুখে। ছেড়ে দিল ট্যাক্সিটা। সেই গলি ধরে ডাইনে বয়ে কয়েকটা বাঁক নিতেই হঠাৎ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মারিয়া আশ্চর্য! কোন রাস্তায় কিভাবে এলাম? ওই তো সামনে দেখা যাচ্ছে গির্জাটা!
গজ পঞ্চাশেক দূরে খালের ধারে দেখা যাচ্ছে বিমর্ষ চেহারার এক গির্জা। একেবারে ঝুরঝুরে। দেখলে মনে হয় যে কোন সময়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। রানা আন্দাজ করল, বয়স এটার অন্তত চারশো বছর তো হবেই। একমাত্র বিশ্বাসের জোরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনও। এতদূর থেকেও পরিষ্কার বুঝতে পারল সে, গির্জার মাথায় চৌকোণ টাওয়ারটা অন্তত পাঁচ ডিগ্রী হেলে রয়েছে খালের দিকে মনে হয় জোরে একটা ধমক দিলেই গোটা গির্জাটা ঝপাৎ করে ডাইভ দিয়ে পড়বে খালে। অল্পদিনেই ফান্ড, সংগ্রহের কাজে। নামতে হবে হিউগানট সোসাইটিকে গির্জাটা সম্পূর্ণ ধসিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে গড়ার জন্যে।
চারপাশে চোখ বুলিয়ে রানা বুঝতে পারল, কেবল গির্জাটাই নয়, পুরো এলাকার প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িই তৈরি হয়েছে কয়েক শতাব্দী আগে। খালের। ধারে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে বাড়িঘর। মস্ত লম্বা বুমসহ প্রকাণ্ড এক ক্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে পরিষ্কার করা জায়গার ঠিক মাঝখানে। বুমটা এতই উঁচু যে অন্ধকারে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না ওটার শেষ মাখা। খুব দ্রুত কাজ চলছে বলে মনে হলো–একপাশে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার। করে ফাউন্ডেশন পর্যন্ত উঠে পড়েছে গোটা কয়েক হবু মাটিস্টোরিড বিল্ডিং।
ক্যানেলের ধার ঘেষে এগেল ওরা ধীর পায়ে। কিছুদূর এগিয়েই কানে। এল অর্গানের বাজনা, সেইসাথে মহিলা কণ্ঠের গান। গানের সুরে মধুর একটা নিরাপদ শান্তির বাণী টের পেল রানা–ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল ওর। মনে পড়ে গেল ঢাকায় সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের সেই নিঃসঙ্গ গির্জাটার কথা; ব্রাদার জুড, ব্রাদার লিগোরির কথা, ধনাইয়ের কথা; ছাতখোলা ল্যাট্রিনের নালায় নিমের বীচি আর প্রস্রাবের ঝাঝের কথা; টিফিন আওয়ারে গোল্লাছুটের কথা, কবে এই ধরাবাঁধা নিয়ম আর উঁচু পাঁচিলের বেড়া ডিঙিয়ে বেরোতে পারবে সেই ভেবে বড় হওয়ার তীব্র বাসনার কথা; ধনাইয়ের বাজানো ঢং ঢং ছুটির ঘণ্টার কথা; স্কুল-মাঠের ওপর দিয়ে সুতো ঝুলিয়ে কাটা-ঘুড়ি উড়ে যাওয়ার কথা।
কি ভাবছেন? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।
না, কিছু না। ভাবছি, সার্ভিস চলছে এখনও…তুমি বরং এক কাজ করো, ভেতরে গিয়ে… বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল রানা। সাদা রেনকোট পরা কালো চুলের এক মেয়েকে ওদের পাশ কাটিয়ে ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে গির্জার দিকে এগোতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তারপর ডাকল, এ্যাই
নির্জন রাস্তায় পুরুষকণ্ঠে এই ধরনের ডাক এলে কি করতে হয় ভালমতই জানা আছে মেয়েটার-ঝট করে একবার রানার দিকে চেয়েই ঝেড়ে দৌড় দিল সে। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই ভেজা কাকরে পা পিছলে হোঁচট খেলো, সামলে নিয়ে আরও দুই কদম যেতে না যেতেই ধরে ফেলল ওকে রানা। কয়েক সেকেন্ড ধস্তাধস্তি করেই হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল মেয়েটা, দুই হাতে জড়িয়ে ধরল রানার গলা। কাছে এসে দাঁড়াল মারিয়া। হাঁ হয়ে গেছে ওর মুখটা।
পরিচিত কেউ? জিজ্ঞেস না করে পারল না সে।
আজই সকালে পরিচয় হয়েছে। এর কথা বলেছি তোমাকে মারিয়া, এরই নাম ইরিন। ইরিন মাগেনথেলার।
ও। ইরিনের বাহুর ওপর হাত রাখল মারিয়া, কিন্তু ওকে তেমন পাত্তা দিল না ইরিন, আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রানার গলা, মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে রানার মুখের দিকে, ঠিক চার ইঞ্চি দূর থেকে।
তুমি খুব ভাল, দ্বিতীয়বার ঘোষণা করল ইরিন। আমি তোমাকে ভালবাসি।
হ্যাঁ, সেটা আমি জানি। সকালেই বলেছ তুমি আমাকে। মুসিবত!
কি করা যায় এখন? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।
সেটাই ভাবছি। তুমি চিনতে পারবে না, আমারই পৌঁছে দিতে হবে। ওকে বাড়িতে। ট্যাক্সিতে তুলে দিলে প্রথম ট্র্যাফিক লাইটে পৌঁছেই ভাগবে। গাড়ি থেকে নেমে। খুব সম্ভব নাক ডাকাচ্ছে বুড়িটা, সেই সুযোগে পালিয়েছে ও বাড়ি থেকে। ওর বাপ হয়তো এতক্ষণে চষে বেড়াচ্ছে সারা শহর।
বেশ কিছুটা জোর খাটিয়েই গলা থেকে ইরিনের একটা হাত খসাল রানা, আস্তিন তুলে ফেলল ওপরে। হাইপোডার্মিকের খোঁচায় খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত। হাতটার দিকে চেয়ে নিজের অজান্তেই ইশশ বলে উঠল মারিয়া। গাল দুটো– কুঁচকে গেছে ওর হাতের অবস্থা দেখে। আস্তিনটা টেনে নামিয়ে দিল রানা। সকালের মত কান্নায় ভেঙে না পড়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে খিল খিল করে। হাসতে শুরু করল ইরিন, যেন খুব মজার কাণ্ড হচ্ছে একটা। বামহাতটাও পরীক্ষা করে দেখল রানা, নামিয়ে দিল আস্তিন।
নতুন কোন দাগ নেই, বলল রানা।