হয় এরকম, সমব্যথীর মত বলল রানা। একে বলে কংকাসিভ অ্যামনেশিয়া। অনেকে বাপের নাম পর্যন্ত ভুলে যায়। তবে ঘাবড়াবার কিছু নেই, সেরে যায় এ রোগ সহজেই। আলতো করে তর্জনী দিয়ে স্পর্শ করল, রানা মেয়েটার জুলফির কাছে। জখমটা এখন কেমন, মিস শেরম্যান?
বলছি তো, আমি দুঃখিত, আমি…।
ইংরেজি বলতে পারো না। শুনেছি। কিন্তু বুঝতে তো কোন অসুবিধে আছে বলে মনে হচ্ছে না? বিশেষ করে লিখিত ইংরেজি। ইংরেজি কথায় লজ্জা পেয়ে লাল হতেও কোন অসুবিধে নেই।
উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। হাতের পত্রিকাটা গোল করে জড়াচ্ছে, আবার খুলছে নিজের অজান্তেই। শত্রুপক্ষের। মেয়ে, সন্দেহ নেই। রানার বিরুদ্ধে কাজ করছে, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। এয়ারপোটে ইমিগ্রেশনের দরজার মুখে রানাকে বাধা দিয়ে খুনীকে। পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল, তাও ভাল করেই জানা আছে রানার। কিন্তু। তবু কেন যেন কৃপা হলো রানার মেয়েটির প্রতি। কেন করছে মেয়েটা এই কাজ? স্বেচ্ছায়, না বাধ্য হয়ে? হাবভাব, চালচলনে তো পাজি মেয়ে বলে মনে হয় না। তাহলে? ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে ওকে? যাই হোক, মেয়েটা শত্রুপক্ষের হোক আর যাই হোক, ওকে এই অপ্রস্তুত, অসহায় অবস্থায় ফেলে মনে মনে খুশি হতে পারল না রানা। তবু তির্যক ভঙ্গিতে বলল, বাকি কাগজগুলো দেব? দেখবে? ইচ্ছে করলে নিতে পারো তুমি ওগুলো, আমার আপত্তি নেই।
ওয়েস্টপেপার বাস্কেটের দিকে চাইল মেয়েটা। আমতা আমতা করে। বলল, ওগুলো নিয়ে আমি কি…
হুম। ইংরেজি বলবার ক্ষমতা ফিরে আসছে আবার। দেখেছ? বলেছিলাম না?
আরও লাল হয়ে উঠল মেয়েটা ইংরেজিতে কথা বলে ফেলেছে বুঝতে পেরে। প্লীজ, আমি
পরচুলাটা সরে গেছে একপাশে, মিস শেরম্যান।
চট করে হাতটা উঠল ওর চুলে, ঠকানো হয়েছে বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে নামাল হাতটা, নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছে দাঁত দিয়ে, খয়েরী চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। এই কাজটা করে নিজের ওপর বিন্দুমাত্র সন্তুষ্ট হতে পারল না। রানা, বরং অনুশোচনা হলো।
প্লীজ। যেতে দিন আমাকে। পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল মেয়েটা।
যে কোন মুহূর্তে কেঁদে ফেলতে পারে এখন, সেই ভয়ে চট করে সরে দাঁড়াল রানা মেয়েটার পথ ছেড়ে। এত সহজে ছাড়া পেয়ে যাবে সেটা হয়তো আশা করেনি, কয়েক সেকেন্ড রানার মুখের দিকে চেয়ে থেকে দ্রুতপায়ে। বেরিয়ে গেল মেয়েটা হোটেল ছেড়ে। ধীর পায়ে পিছন পিছন এসে দাঁড়াল রানা দরজার সামনে। বেশ জোরেশোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে বাইরে। ছাতাটা খুলে নিয়ে দ্রুতপায়ে রওয়ানা হয়ে গেল বিট্রিক্স শেরম্যান ক্যানালের দিকে। বিশ সেকেন্ড পর দেখতে পেল রানা ছাতা মাথায়, ভিজে সপসপে অলেস্টার গায়ে ওই একই দিকে চলেছে সোহানা আর মারিয়া–একবারও চাইল না ওরা হোটেলের সদর দরজার দিকে।
খুব একটা সুখী বলে মনে হলো না ওদের মুখের দিকে চেয়ে।
আবার গিয়ে ঢুকল রানা বারে। অপেক্ষা করতে হবে ওকে আরও অন্তত আধঘণ্টা।
.
০৮.
লোকজনের কথাবার্তায় আর গ্লাসের টুংটাং শব্দে সরগরম ওল্ডবেলে দরজার দিকে মুখ করে বসল রানা একটা টেবিলে। দরজার দিকে পিঠ ফিরে বসবার ব্যাপারে কোন কুসংস্কার বশে নয়, সোহানা বা মারিয়া যেই হোক পৌঁছলে যেন চট করে দেখতে পায় সেইজন্যেই দরজার দিকে মুখ করে বসল সে এক মগ বিয়ার নিয়ে। বিশ মিনিট অপেক্ষার পর ঢুকল মারিয়া। স্কার্ফ আর ছাতা থাকা সত্ত্বেও ভেজা চুল গালের সঙ্গে লেপটে রয়েছে ওর।
খবর সব ভাল? জিজ্ঞেস করল রানা।
সামনের চেয়ারে বসে পড়ল মারিয়া। বার দুয়েক লম্বা করে শ্বাস টেনে বলল, চুপচুপে হয়ে ভেজাটা যদি ভাল মনে করেন, তাহলে খবর খুবই ভাল।
মৃদু হেসে একটা শেরির অর্ডার দিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা, আর সোহানা?
সেও ভাল আছে। শেরিতে চুমুক দিল মারিয়া।
এবার তৃতীয়জনের কথা শোনা যাক। যাকে অনুসরণ করছিলে। তার খবর কি? কোথায় ও এখন?
গির্জায়।
কী?
মাথা দুলিয়ে হাইম গাইছে।
মাশাল্লা। আর সোহানা?
সেও গির্জায়।
ও-ও কি গান গাইছে?
হাসল মারিয়া। তা বলতে পারব না। আমি ভেতরে ঢুকিনি।
সোহানারও বোধহয় না ঢোকাই উচিত ছিল, ভুরু কুঁচকে বলল রানা।
গির্জার চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর আছে কোথাও?
তা ঠিক। ঠিকই বলেছ। মুখে বলল ঠিকই, কিন্তু কেন যেন ভিতর ভিতর একটা অস্বস্তিবোধ খোঁচাতে শুরু করল ওকে।
রানার মনের ভাবটা আঁচ করে নিয়ে মারিয়া বলল, আমাদের একজনকে থেকে যেতে বলেছিলেন না?
বলেছিলাম।
সোহানা বলল, গির্জার নামটা শুনলে নাকি অবাক হবেন আপনি।
অবাক হব? নাম শোনার আগেই অবাক হলো রানা। গির্জার নাম শুনে অবাক হওয়ার•• থেমে গেল রানা। বিস্ফারিত চোখে চাইল মারিয়ার মুখের দিকে। দা ফাস্ট রিফর্মড চার্চ অফ দা অ্যামেরিকান হিউগানট সোসাইটি? মারিয়াকে মাথা নাড়তে দেখে একলাফে উঠে দাঁড়াল রানা। এতক্ষণে বলছ সেকথা! উঠে পড়ো। আমি বিলটা দিয়ে আসছি, চট করে শেষ করে ফেলো গ্লাসটা।
কি ব্যাপার, মেজর রানা? গির্জার কথা শুনে…
মারিয়ার কথা শেষ হওয়ার জন্যে আর অপেক্ষা করল না রানা, কাউন্টারে গিয়ে দাম চুকিয়ে এল চট করে। বাইরে বেরিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল মারিয়া, এত ব্যস্ত হওয়ার কি ঘটেছে?