সত্যিই চমৎকার। দেখতে দেখতে টলটলে দুফোঁটা পানি দেখা দিল সোহানার অপূর্ব সুন্দর চোখে। আমার জন্যে…শুধু আমার জন্যে তুমি…অথচ ভুল বুঝে আমি তোমাকে টপ করে টেবিলের ওপর পড়ল দুফোঁটা পানি, আরও দুফোঁটা ম্যানুফ্যাকচার হচ্ছে। কাঁপা শ্বাস টানল সোহানা। সেজন্যেই সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আমার আগে আগে উঠেছ তুমি, নামার সময় নেমেছ পিছু পিছু–গুলি যদি করে, যেন তোমার ওপর দিয়েই যায়। টেবিলের ওপর রানার একটা হাত চেপে ধরল সোহানা। আমি তোমার। যোগ্য নই রানা। তোমাকে বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। আমি জানি, কোনদিন তল পাব না আমি তোমার।
দি এন্ড। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল এক সেইলার। তারপর নাকে টোকা দিয়ে। পিড়িং পিড়িং ডাচ,জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে শুরু করল। হুড়মুড় করে সব কজন। উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। অর্থাৎ, সিনেমা শেষ! কান্নার মধ্যে দিয়ে মিলন হয়েছে নায়ক নায়িকার।
হেসে ফেলল রানা ও সোহানা একসাথে এতক্ষণ যে গভীর মনোযোগের সাথে ওদের নাটক দেখছিল সবাই, টের পেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল সোহানার দুই গাল। এক ঢোকে নিজের স্কচ শেষ করে, আধ ঢেকে সোহানারটুকুও নামিয়ে দিল রানা গলা গিয়ে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দর্শকদের উদ্দেশে বো করে বলল, নাড জেন্টলমেন, দা শো ইজ ওভার। ইউ হ্যাভ টু পে ফর দা ড্রিঙ্কস্।
হৈ হৈ করে হাসির হুল্লোড় তুলল নাবিকরা, চার-পাঁচজন একসাথে পকেটে হাত দিল রানাদের ড্রিঙ্কসের বিল দেয়ার জন্যে। হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ওরা পাব থেকে।
হোটেলের দোরগোড়ায় হঠাৎ দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে চুমো খেলো সোহানা রানাকে। কানের কাছে নরম গলায় বলল, মাফ করেছ?
না তো! অবাক হওয়ার ভান করল রানা। এখন কি? সে সব তো ফয়সালা হবে শয়নে।
অসভ্য। বলেই হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চলে গেল সোহানা হোটেলের ভিতর।
.
০৭.
অলিগলি বেয়ে সোহানার হোটেল থেকে আধ মাইল খানেক দূরে সরে এল। রানা হেঁটে, তারপর ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ফিরে এল নিজের হোটেলে। ওভারকোটটা হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে পেছন ফিরতেই চোখ পড়ল ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের ওপর। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে রানার দিকে চেয়ে।
য্যানডাম থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন?
মাঝ রাস্তায় মনে পড়ে গেল বাথরূমের চেইন টানা হয়নি, তাই ফিরে এলাম, বলল রানা। না, না, এক্ষুণি চাবি লাগবে না, আপাতত বারে যাচ্ছি।
হুইস্কির গ্লাস সায়া নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল রানা। কি তথ্য সংগ্রহ করেছিল ইসমাইল যার জন্যে প্রাণ দিতে হলো ওকে? নাকি এটা ওর প্রতি সাবধানবাণী? ইসমাইলকে ব্যবহার করা হয়েছিল শুধু ওকে চিনে নেয়ার। জন্যে? গোপনে ঘর সার্চ করছে, হোটেল থেকে বেরোলেই অনুসরণ করছে, সর্বক্ষণ ওর ওপর নজর রাখছে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আর সেই সঙ্গে আরও কজন কে জানে, পুতুলের পেছনে দেখা যাচ্ছে একজোড়া চোখ, ইন্সপেক্টরের। ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে তার পালিতা মেয়েকে হেরোইন সাপ্লাই দিয়ে, অথচ ধরা যাচ্ছে না কাউকে সব মিলিয়ে কি দাঁড়ায়? সবকিছু জগাখিচুড়ি পাকিয়ে মস্ত একটা ঘোড়ার ডিম হয়ে যাচ্ছে না?
একমাত্র ভরসার কথা, রানার ওজন এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি ওরা। সেইজন্যেই দ্বিধা করছে ওকে সাফ করে দেয়ার ব্যাপারে। আর কোন কারণ থাকতে পারে না ওকে এভাবে অবাধে ঘুরতে ফিরতে দেয়ার, বাঁচিয়ে রাখার। এখনও ওদের যথেষ্ট পরিমাণে উত্যক্ত করতে পারেনি সে, এমন কিছু করতে পারেনি যাতে ওদের পিলে চমকে যেতে পারে। যতক্ষণ না সেটা ঘটছে, ভদ্রতার মুখোশ খসাবে না ওরা-কদিন রাডহাউন্ডের মত হন্যে হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে হতাশ হয়ে যদি সে ফিরে যায় দেশে, সেটাই তো লাভ। ওদের চমকে দিতে হলে গভীর রাতে আজ আর একবার যেতে হবে ওর ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে একা। সোহানাকে ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিলে চলবে না। অন্য কোন লাইন যখন খুলছে না, এইদিকেই। আর একটু চাপ দিয়ে দেখতে হবে ওদের প্রতিক্রিয়া। ঠিক কটার সময় রওনা হলে ভাল হয় ভেবেচিন্তে স্থির করবার চেষ্টা করছিল রানা, এমনি সময়ে হঠাৎ চোখ তুলে চাইল সে সামনের আয়নার দিকে। ই এস পি বা ষষ্ঠেন্দ্রিয় বা ওই জাতীয় কিছু নয়, পরিচিত একটা গন্ধ নাকে আসতেই কৌতূহলী চোখ তুলল সে গন্ধের উৎসটা দেখবার জন্যে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই আবছাভাবে পাচ্ছিল সে গন্ধটা, হঠাৎ বুঝতে পারল ওটা চন্দন কাঠের গন্ধ, চট করে মনে পড়ল এর আগে কোথায় পেয়েছিল সে এই গন্ধটা–তাই এই ঔৎসুক্য।
রানার ঠিক পেছনের টেবিলেই বসে রয়েছে মেয়েটা, টেবিলের ওপর। একটা ডিস্ক, হাতে খবরের কাগজ। আয়নার দিকে চোখ তুলেই রানার মনে হলো, ওর দিকেই চেয়ে ছিল মেয়েটা, ও চোখ তুলতেই চট করে নামিয়ে নিল দৃষ্টি। অল্পবয়সী মহিলা, সবুজ একটা কোট পরনে, সোনালী চুল এতই আধুনিক ফ্যাশানে কাটা যে রানার মনে হলো ফুল বাগানের ডাল ছাটবার কাঁচি দিয়ে পাগলের হাতে ছাঁটা হয়েছে চুলগুলো।
আরেক পেগ হুইস্কি চাইল রানা, শেষ হয়ে যাওয়া গ্লাসটা তুলে নিয়ে নতুন একটা গ্লাস নামিয়ে রাখল ওয়েটার টেবিলের ওপর। দ্বিতীয় গ্লাসটা স্পর্শ না করেই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল সে, ধীরপায়ে এগোল হোটেলের সদর দরজার দিকে। মেয়েটার পাশ কাটিয়ে যাবার সময় ওর দিকে একবার চাইল না পর্যন্ত–এতই চিন্তাময় ভঙ্গি রানার। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে ব্যস্ত। হয়ে উঠতে দেখে সান্তনার ভঙ্গিতে হাত তুলল রানা, বলল, বেশি দূরে। কোথাও যাচ্ছি না, দুই মিনিটেই ফিরে আসছি। ঘাবড়াবার কিছুই নেই।