চুক চুক শব্দ করল রানা জিভ দিয়ে, তারপর ঠোঁটের উপর আঙুল রাখল। একটা। আর কোন কথা নয়। মনে রেখো, আমি যাহা জানি, তুমি জানো না…বস অলওয়েজ নোজ বেস্ট। চলো, এগোও।
কয়েক সেকেন্ড দুই চোখ দিয়ে আগুন ঝরল সোহানার, তাতে যখন, রানাকে ভস্ম করা গেল না তখন বুঝতে পারল এই লোকের সঙ্গে কথা বলে। কোন লাভ নেই, ঝট করে ঘুরে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দুমদাম পা ফেলে নামতে শুরু করল নিচে। পেছন পেছন নামছে রানা–প্রথম পনেরোটা ধাপ নামতে নামতেই চিকন ঘাম দেখা দিল ওর কপালে, ভয়ের শীতল হোত বইল শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে বারকয়েক ওপর থেকে নিচে, নিচে থেকে ওপরে। একেবারে নিচতলায় নেমে সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে তালা না মারা। পর্যন্ত থামল না শিরশিরানি।
দ্রুতপায়ে ফিরে চলল ওরা মেইন রোডের দিকে। সোহানার হাত ধরবার। চেষ্টা করে বিফল হলো রানা। তিনহাত তফাতে হাঁটছে সে, মাঝে মাঝে। চোখের কাছে হাত তুলতে দেখে আন্দাজ করল হয়তো কাঁদছে ও। গজ পঞ্চাশেক চুপচাপ হেঁটে খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল রানা।
যে লোক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাদপসারণ করতে পারে সে আরেকবার যুদ্ধের সুযোগ পায়। মেজর জেনারেল রাহাত খানের সুপরিচিত কোটেশন ঝাড়ল রানা, কিন্তু কোনই ফল হলো না তাতে। রাগে ফুঁসছে সোহনা।
দয়া করে আমার সঙ্গে কথা বোলো না তুমি। গলার স্বর কাঁপছে আবেগে।
অবস্থা বেগতিক দেখে চুপ হয়ে গেল রানা। কিন্তু বেশ কিছুদূর হাঁটবার পর যেই একটা পাবৃ দেখতে পেল, খপ করে ধরে ফেলল সে সোহানার হাত, টেনে নিয়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঢুকতে হলো সোহানাকে, নইলে সীন ক্রিয়েট করতে হয়।
সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায়ান্ধকার এক ড্রিঙ্কিং ডেন। জনাকয়েক সেইলার যার যেমন খুশি একেবেঁকে, কেউ আবার টেবিলের ওপর পা তুলে বসে ছিল গ্লাস সামনে নিয়ে, মহিলাসহ রানাকে ঢুকতে দেখে সোজা হয়ে বসল, শান্তি। ভঙ্গ করায় আহত দৃষ্টিতে চাইল রানার দিকে। কারও দৃষ্টির কোন তোয়াক্কা না করে সোহানাকে নিয়ে কোণের এক টেবিলে গিয়ে বসল রানা। টেবিলটা দেখে মনে হচ্ছে যোড়শ শতাব্দীর অ্যান্টিক–জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত– সাবান বা পানির সঙ্গে কোন সংশ্রব ঘটেনি তার।
আমি স্কচ খাব। তুমি?
স্কচ। নির্বিকার কণ্ঠে বলল সোহানা।
তুমি না স্কচ খাও না?
আজ খাব।
বেপরোয়া ভঙ্গিতে গ্লাসের অর্ধেকটা একঢোকে খাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে কাশতে শুরু করল সোহানা ভড়কে গিয়ে। চোখমুখ লাল হয়ে উঠতে দেখে গোটা কয়েক থাবড়া দিল রানা ওর পিঠে।
হাত সরাও।গা ঝাড়া দিল সোহানা। খবরদার, ছোবে না তুমি আমাকে!
অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে নিজের গ্লাসে মন দিল রানা।
তোমার সঙ্গে কাজ করবার শখ মিটে গেছে আমার, রানা। কান ফিরে যাচ্ছি আমি। গলাটা আবার নিজের আয়ত্তে আসতেই ঘোষণা কম। সোহানা। কালই ফিরে যাব আমি ঢাকায়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমার ওপর যার আস্থা নেই, যে আমাকে বিশ্বাস করে না, এমন। লোকের সঙ্গে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ বলে গণ্য করো না তুমি আমাদের। এতটা তাচ্ছিল্য সহ্য করে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কেউ তোমার সঙ্গে কাজ করতে পারবে না।
আমি তোমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করিনি, সোহানা-অমানুষ বলেও গণ্য করিনি, অবিশ্বাসও করিনি, অনাস্থাও প্রকাশ করিনি। সহজ সহজ কণ্ঠেলল রানা।
অফকোর্স ইউ স দেম, সোহানা, তিক্তকণ্ঠে রানার বাচনভঙ্গি আর। রানার গলার সুর নকল করে ভ্যাংচাল সোহানা। আই বিলিভ ইউ, সোহানা। অবিশ্বাস করছি না। ইউ ডোন্ট বিলিভ মি অ্যাটল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ঠাট্টার পাত্রী আমি তোমার। আমাকে টিটকারি মেরে তুমি নিজেকে…
না, সোহানা। মাথা নাড়ল রানা। সত্যিই বিশ্বাস করেছিলাম আমি তোমার কথা। সত্যিই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল আমার। কসম খোদার। বিশ্বাস করেছিলাম বলেই মানে মানে কেটে পড়েছি ওখান থেকে।
অবাক হয়ে চেয়ে রইল সোহানা কয়েক সেকেন্ড রানার মুখের দিকে। বিশ্বাস করেছিলে…তাহলে, তাহলে কেন–
কেন তাড়া করে ধরলাম না ওকে? কারণটা পানির মত সহজ। একটু সামনে ঝুঁকে এল রানা। সত্যিই ওই র্যাকের পেছনে লুকিয়ে ছিল একজন লোক। চোখ দেখতে পাইনি, কিন্তু দুটো পুতুলকে সামান্য দুলতে দেখেছি আমি। র্যাকটার আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ রেখেছিল লোকটা আমাদের ওপর, দেখছিল আমরা কোন তথ্য প্রমাণ পেয়ে যাই কিনা। আমাদের খুন করবার কোন ইচ্ছে লোকটার ছিল বলে মনে হয় না। থাকলে সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়েই গুলি করতে পারত। কিন্তু তোমার কথামত যদি আমি লোকটাকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করতাম, তাহলে অবধারিতভাবে কি ঘটত কল্পনা। করতে পারো? গুলি করা ছাড়া গত্যন্তর থাকত না ওর আর। লোকটা ঠিক কোন্ জায়গাটায় আছে সেটা বুঝে ওঠার আগেই গুলি খেতে হত আমার। আমাকে খুন করে খুনের সাক্ষী হিসেবে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখত না সে কিছুতেই। বিশ্বাস করো, তোমাকেও মরতে হত ওখানেই। এখন তোমার প্রেম করবার বয়স, হুট করে মরে যাওয়াটা কি উচিত হত? বলো? আর একটা কাজ করা যেত যদি তুমি ওখানে না থাকতে…ওর সাথে লুকোচুরি খেলে ওকে। কাবু করবার চেষ্টা করতে পারতাম আমি। কিন্তু তুমি ছিলে ওখানে মস্ত বড় বাধা হিসেবে। পিস্তল নেই তোমার কাছে, এ ধরনের নোংরা খুনোখুনির অভিজ্ঞতা নেই–কাজেই ভাবলাম এসবের মধ্যে তোমাকে না জড়ানোই ভাল। কাজেই, তোমাকে টিটকারি দিইনি আসলে আমি, ওই লোকটাকে। বোঝাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম যে তোমার কথা একেবারেই বিশ্বাস। করিনি আমি, কাজেই খোঁজাখুঁজিও করব না। সেই সময়েই ইংরেজি বুলি ছুটে গিয়েছিল আমার মুখ দিয়ে, লক্ষ্য করোনি? ওর সাথে কথা বলছিলাম আমি। আসলে। ওকে কোনমতে একটা কিছু বুঝ দিয়ে মানে মানে কেটে পড়বার তালে ছিলাম। বোঝা গেল? কেমন লাগল বক্তৃতাটা? চমৎকার না?