চারতলার পুরোটা জুড়ে শুধু পুতুল আর পুতুল। অসংখ্য। হরেক আকৃতির। একেবারে ছোট থেকে নিয়ে ইরিনের হাতে যেটা ছিল তার চেয়েও বড় পুতুল রয়েছে, অতি যত্নের সাথে অপূর্ব সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে প্রত্যেকটা। নানান রঙের ঝকমকে ডাচ ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরানো সব পুতুল। বড়গুলো দাঁড় করানো আছে র্যাকের পেছনে একটা দড়ির গায়ে। হেলান দিয়ে, ছোটগুলো ঝুলছে সুতো বাধা অবস্থায়। সবুজ, নীল, খয়েরী। চোখের মিষ্টি সব পুতুল।
সাহসিকা সোহানা একহাতে খামচে ধরে আছে রানার কোটের হাতা। ভয়ে ঈষৎ বিস্ফারিত হয়ে গেছে ওরআয়ত চোখ। ফিসফিস করে বলল, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে শিরশির করছে সারা শরীর। মনে হচ্ছে জ্যান্ত সব পুতুল, লক্ষ করছে আমাদের।
ফিসফিস কররার দরকার নেই, বলল রানা মৃদু হেসে। দেখছে ঠিকই, কিন্তু আমি শিওর, একটা কথাও শুনতে পাচ্ছে না পুতুলগুলো। ঠিক এই রকম কাপড় পরা একটা জ্যান্ত পুতুল দেখেছি আমি আজ সকালে ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের বাসায়। ইরিনের নার্স। এগুলো সব এসেছে যাইডার যীর। হাইলার দ্বীপ থেকে। ইরিনের হাতেও দেখেছি একটা পুতুল, ঠিক এই রকম। শেষের কথাগুলো যেন সোহানাকে নয়, নিজেকেই শোনাবার জন্যে বলল রানা।
ইরিন কে?
অ্যামস্টার্ডামের নারকোটিক্স ব্যুরোর চীফ ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের, পালিতা মেয়ে। ড্রাগ অ্যাডিক্ট।
ইন্সপেক্টরের মেয়ে ড্রাগ অ্যাডিক্ট? কি ব্যাপার ব্ল্যাকমেইল?
মেয়েটার মাধ্যমে পথে আনবার চেষ্টা করছে ওরা মাগেনথেলারকে। গোপনে হেরোইনের ডোজ সাপ্লাই দিচ্ছে ইরিনকে।
রানার হাত ছেড়ে দিয়ে চারপাশে টর্চ বুলাল সোহানা, রানা এগিয়ে গিয়ে মন দিল একটা পুতুল পরীক্ষায়। হঠাৎ দ্রুত শ্বাস টানবার শব্দে ঝট করে পেছন। ফিরল সে। দেখল, পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোহানা, টর্চের আলোটা ধরা আছে একটা র্যাকের গোটা কয়েক পুতুলের দিকে। ধীর, নিঃশব্দ পায়ে পিছিয়ে আসছে সে রানার দিকে, চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে রয়েছে টর্চের আলোয়। আলোকিত জায়গাটার ওপর, পেছনে হাঁটছে আর বাম হাতে খুঁজছে সে রানাকে। কাছে আসতেই ধরল রানা হাতটা, মৃদু চাপ দিল। দৃষ্টিটা সরাল না। সোহানা রানার স্পর্শ পেয়েও। রানা টের পেল প্রবল বেগে কাঁপছে ওর হাতটা।
চাপা, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সোহানা, একটা লোক! রানা! লক্ষ করছে আমাদের!
আলোকিত র্যাকের দিকে চাইল রানা, সঙ্গে সঙ্গেই চোখ সরিয়ে নিল। সোহানার হাত ধরে টেনে ওকে নিজের দিকে ফেরাল। চোখ ফেরাতে পারছিল না সোহানা র্যাকের ওপর থেকে, বহুকষ্টে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল সে রানার দিকে–যেন সম্মোহনের প্রভাব কাটিয়ে উঠল। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল। রানা ওর চোখের দিকে। কি ব্যাপার? হোয়াটস দা ম্যাটার?
আমি দেখেছি! নিজের চোখে দেখেছি! ভয়ে দেড়গুণ বড় হয়ে গিয়েছে। ওর আয়ত চোখ।
কি দেখেছ?
একজোড়া চোখ! র্যাকের ওপাশে!
অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না, সোহানা যে ভুল দেখেনি সে ব্যাপারেও রানা স্থির নিশ্চিত–কারণ, যত কল্পনাপ্রবণ মেয়েই হোক, কঠোর ট্রেনিং পেয়েছে সে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স থেকে অবজার্ভেশনের সঙ্গে ইমাজিনেশন না মেশাবার ব্যাপারে। হাতের উজ্জল টর্চটা ধরল রানা র্যাকের দিকে, অসাবধানে সোহানার চোখে লেগে গেল আলোটা মুহূর্তের জন্যে, চোখ ধাধিয়ে যাওয়ায় চট করে একটা হাত তুলল সে চোখে। কোন মানুষ বা তার চোখ দেখতে পেল না রানা, কিন্তু যেটুকু দেখতে পেল তাতেই বুঝে নিল। সে যা বোঝার। ঘরে দমকা তো দূরের কথা, মৃদু হাওয়া ঢুকবারও কোন ব্যবস্থা নেই–অথচ দুটো পুতুল দুলছে অল্প অল্প; এতই সামান্য, যে ভাল করে লক্ষ না করলে ঠাহর করা যায় না।
সোহানার হাতে মৃদু চাপ দিল রানা। হাসল মিষ্টি করে। দেখো, সোহানা–
বিশ্বাস করছ না তুমি? আমি দেখেছি। ভয়ঙ্কর একজোড়া চোখ! কসম খেয়ে বলতে পারি-সত্যিই দেখেছি আমি।
অফকোর্স ইউ স দেম, সোহানা। সন্দেহ তো করছি না। নো ডাউট অ্যাবাউট ইট। বলল রানা, কিন্তু এমন সুরে বলল যে পাই করে ঘুরল সোহানা ওর দিকে। মর্মাহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে কয়েক সেকেন্ড রানার মুখের দিকে, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না সে, এই রকম একটা অবস্থায়। ওকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করতে পারে রানার মত দায়িত্বশীল এক লোক। একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে সে রানার ব্যবহার দেখে।; একই সুরে রানা। বলল, আই বিলিভ ইউ, সোহানা। ঠিকই দেখেছ তুমি–অবিশ্বাস করছি না।
বিশ্বাস করার নমুনা কি এই? রেগে গেল সে। কিছু করছ না কেন। তাহলে?
করছি না কেন বললে? আবার হাসল রানা। আই অ্যাম গেটিং দা হেল আউট অভ হিয়ার। সোজা বাংলায় ভাগছি। যেন কিছুই ঘটেনি, এমনি ভঙ্গিতে সারা ঘরে একবার টর্চটা বুলিয়ে নিয়ে বাম হাতে সোহানার পিঠ জড়িয়ে ধরল রানা। চলো, কেটে পড়া যাক। দেখার মত কিছুই নেই। এখানে। গলা শুকিয়ে গেছে আমার–একটা ড্রিঙ্ক না হলে আর চলছে না। এখানকার এই ভৌতিক পরিবেশ নার্ভাস করে ফেলেছে আমাকেও।
এক ঝটকায় রানার হাত সরিয়ে দিল সোহানা। ওর মুখে রাগ, দুঃখ আর। হতাশা দেখতে পেল রানা। ওকে নিয়ে ঠাট্টা করায় এবং ওর কথা বিশ্বাস না। করায় একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছে সে। মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু…রানা, আমি যে বলছি…