শুধু শয়নে করলে চলে না?
তাতে কি লাভ?
তাহলে আর ইমিডিয়েট মাফটাফের মধ্যে না গিয়ে তোমার জন্যে নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করতে পারি আমি বিছানায় শুয়ে।
তোমার ওই এক কথা। ওসব ছাড়া আর কিছু নেই যেন মানুষের জীবনে।
আর কি আছে? শুকনো আদর? ওসবে আমার… গলার স্বর পরিবর্তন। করল রানা। দাঁড়াল। এসে গেছি।
সাইনবোর্ডটা পড়ল সোহানা মৃদু কণ্ঠে ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানী।
তুমি রাস্তার দুপাশটা লক্ষ রাখো, বলে চার ধাপ সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায়। উঠে পড়ল রানা।
খালি রাস্তাটার দিকে, নাকি
আর আমার পিঠের দিকেও খেয়াল রেখো একটু, কেউ যেন আচমকা ছুরি বসাতে না পারে।
সিঁড়ি দিয়ে দুই ধাপ ওপরে উঠে গলা বাড়িয়ে রাস্তার ওপর চোখ রাখল সোহানা। দুই মিনিটের চেষ্টাতেই খুলে ফেলল রানা দরজাটা। ভিতরে ঢুকে পড়ল দুজন। আবার চাবি মেরে চাবিটা তালার মধ্যেই রেখে দিল রানা। দুজনের হাতে বেরিয়ে এসেছে দুটো টর্চ-বানার হাতেরটা ছোট কিন্তু অত্যন্ত। জোরাল। গোটা একতলায় দেখার মত কিছুই পেল না ওরা। পাশাপাশি তিনটে ঘরে গাদা করা আছে অসংখ্য কাঠের প্যাকিং বাক্স মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত। আর রয়েছে ক্র্যাপ পেপার, কার্ডবোর্ড, খড় এবং বাধাই ও বেলিঙের। যন্ত্রপাতি। মালপত্র প্যাকিং হয় এখানে।
সরু ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলল এবার ওরা। অর্ধেক উঠে ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে চাইল রানা, দেখল সোহানাও তাই করছে, চারপাশে টর্চ বুলিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছে যে আর কেউ নেই।
দোতলার প্রথম দুটো ঘর হাজার পদের সুভ্যেনিরে ঠাসা। ডাচ পিউটার, উইন্ডমিল, কুকুর, বাঁশি-হরেক রকমের জিনিসে সাজানো রয়েছে দেয়ালের গায়ে বসানো শেলফ আর ঘরের মাঝামাঝি আড়াআড়ি করে রাখা র্যাকে। চারপাশে একবার আবছা ভাবে চোখ বুলিয়ে কোন কিছুই সন্দেহজনক বলে। মনে হলো না রানার কাছে। কিন্তু তৃতীয় ঘরের দরজার সামনে এসেই ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল ওর। সোহানাকে ডেকে দেখাল দরজাটা।
আশ্চর্য! চোখমুখ বকাল সোহানা। টাইম লক। সাধারণ একটা অফিসের দরজায় টাইম লক কেন?
এর সহজ উত্তর হচ্ছে এটা সাধারণ একটা অফিস দরজা নয়। একটু লক্ষ করলেই বুঝতে পারবে দরজাটা কাঠের নয়-স্টীলের। ডায়মন্ডের গুদাম হলে একটা কথা ছিল, বোঝা যেত–না, স্টীলের দরজার একটা যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু এখানে? কী এমন জিনিস আছে এদের এখানে এত সাবধানে। রাখবার মত?
মনে হচ্ছে ঠিক জায়গায়ই হাজির হয়েছি আমরা, বলল সোহানা।
আমি তোমাকে ভুল জায়গায় নিয়ে যাব এমন সন্দেহ ছিল বুঝি তোমার?
না। তা ছিল না। কিন্তু এই বাড়িটা আসলে কি? কিসের স্টোরহাউজ?
এখনও বুঝতে পারোনি? সুভ্যেনির ব্যবসার হোলসেলার এরা। ফ্যাকটরিই বলো, বা কুটির শিল্পের কারখানাই বলো, প্রস্তুতকারক সরাসরি মাল পাঠিয়ে দেয় এই স্টোরহাউজে, এখান থেকে বিভিন্ন দোকানের অর্ডার। অনুযায়ী যার যা দরকার প্যাকিং করে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সহজ, সরল, নিপাপ, নিষ্কলুষ, আইনসম্মত, পরিষ্কার ব্যবসা।
কিন্তু খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়, বলল সোহানা নাক কুঁচকে।
অস্বাস্থ্যকর কি পেলে?
বিচ্ছিরি একটা গন্ধ পাচ্ছ না?
ও। ক্যানাবিস।কারও কারও কাছে ক্যানাবিসের গন্ধ খুব খারাপ লাগে।
ক্যানাবিস? কি সেটা?
বেণী বেঁধে স্কুলে যাওয়া-আসা ছাড়া আর কিছুই করোনি জীবনে!.. এপাশ-ওপাশ চাইবার সময় পাওনি। কামন। আপ।
তেতলায় উঠে এল ওরা। কয়েক মিনিট আগেকার তেজ বেমালুম উবে গেছে সোহানার চেহারা থেকে। ফ্যাকাসে মুখে চঞ্চল দৃষ্টি বুলাচ্ছে সে চারপাশে। ক্যানাবিসের গন্ধ আরও বেড়েছে এখানটায়, কিন্তু ঠিক কিসের থেকে আসছে বোঝা গেল না। নিস্তব্ধ এই পুরানো দালানটায় থমথম করছে যেন জঘন্য এক পাপীর প্রেতাত্মা। তিন দেয়ালের তিনটে র্যাকে সারি সারি। সাজানো রয়েছে দেয়াল ঘড়ি। ছোট, মাঝারি, বড়-হরেক রকম। বেশিরভাগই সস্তা দরের, পালিশ করা হলুদ পাইনের কাঠামো। কিন্তু দামী ঘডিও রয়েছে বেশ অনেকগুলো। ভাগ্যিস পেন্ডুলামগুলো থেমে রয়েছে; যদি সবকটা চলতে থাকত তাহলে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার দশা হত ওদের। ঘরের চতুর্থ দেয়ালের শেলফে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত দশটা তাক ঠাসা রয়েছে অদ্ভুত এক জিনিসে-বাইবেল। একেক তাকে তিন সারি করে। বাইবেল রাখা। সুভ্যেনির ওয়েরহাউজে বাইবেল কেন, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না রানা। এগিয়ে গিয়ে একটা বের করল টেনে। চামড়ার কাভার, তার ওপর সোনালী অক্ষরে এমবস করা রয়েছে দি গ্যাব্রিয়েল বাইবেল। মলাট ওল্টাতেই দেখা গেল প্রথম পাতায় ছাপার অক্ষরে লেখাউইথ দা কমপ্লিমেন্টস অফ দা ফাস্ট রিফর্মড চার্চ অফ দা অ্যামেরিকান হিউগানট সোসাইটি।
ঠিক এই রকম একটা বাইবেল রয়েছে আমাদের হোটেল কামুরায়, বলল সোহানা।
মাগনা পেয়েছে, রেখে দিয়েছে হয়তো একটা করে সব ঘরে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে–এগুলো এখানে কেন? প্রিন্টার বা পাবলিশারের গুদাম হলে এক কথা ছিল, এখানে কি করছে এসব? অদ্ভুত ব্যাপার না?
এখানকার সব কিছুই বিদঘুটে ঠেকছে আমার কাছে, বলল সোহানী। বেরোতে পারলে বাঁচি। কথাটা বলেই শিউরে উঠল নিজের অজান্তেই।
মৃদু একটা থাবড়া দিল রানা ওর পিঠে। শীত করছে? আরও দুটো তলা বাকি রয়েছে। চলো, এবার থার্ডফ্লোর।