ইসমাইলের চোখের দৃষ্টি সামান্য একটু বাঁকা হতেই ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিষ্ঠুর লোকটাকে দেখল সে আবার। লোকটা এখন আর রানার দিকে মুখ করে নেই, একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইসমাইলের মুখোমুখি। এয়ারব্যাগটা এখন আর লোকটার হাতে ঝুলছে না, অদ্ভুত ভঙ্গিতে ধরা আছে। বগলের নিচে। চট করে ইসমাইলের মুখের দিকে চেয়ে ভীতি দেখতে পেল। রানা, এবং পরিষ্কার ভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁপ দিল সামনের দিকে।
চোখের পলকে ঘটে গেল কয়েকটা ঘটনা। প্রস্তুত ছিল লোকটা। রানা ঝাঁপ দিতেই সাই করে ব্যাগটা ঘুরিয়ে মারল সে রানার নাভীর ছয় ইঞ্চি ওপরে, সোলার প্লেকসাসে। এয়ারব্যাগ সাধারণত নরম হয়, কিন্তু এটা সেরকম না–অত্যন্ত শক্ত কিছু জিনিসের প্রচণ্ড গুতো খেয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল রানা। তীব্র ব্যথায় গোঙাবার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলল সে। জ্ঞান হারাল না, কিন্তু সারা শরীর অসাড় অবশ হয়ে গেল ওর মুহূর্তে। দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু চোখ ছাড়া আর কিছু নড়াবার ক্ষমতা নেই।
পরবর্তী কয়েকটা সেকেন্ড রানার মনে হলো যেন সো মোশন ছায়াছবি দেখছে। চারপাশে চাইল আতঙ্কিত ইসমাইল, কিন্তু পালাবার পথ পেল না। কোনদিকে। তিনজন লোক, যেন কি ঘটতে চলেছে কিছুই টের পায়নি, দাঁড়িয়ে রয়েছে ইসমাইলের পিছনে। পিছনে পালাবার রাস্তা নেই। সামনে। নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগোনো ছাড়া আর কোন পথ নেই ইসমাইলের।
এদিকে এয়ারব্যাগের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা কালো নলের মাখা। চিনতে পারল রানা-সাইলেন্সর সিলিন্ডার। এরই গুতোয় অবশ হয়ে। গেছে ওর সর্বশরীর। উঠে বসবার চেষ্টা করল সে, পারল না। লোকটার ডান হাত এয়ারব্যাগের মধ্যে। আর একটু উঁচু হলো হাতটা। মুখের ভাবে কোন। পরিবর্তন নেই, ধীরে সুস্থে ঠাণ্ডা মাথায় কাজটা করবে বলে বাড়ি থেকে স্থির। করে এসেছে যেন লোকটা। প্রফেশনাল।
মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ইসমাইলের মুখটা। কি ঘটতে চলেছে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে সে। চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে আছে ভয়ে, কিন্তু তারই মধ্যে ডান হাতটা চলে গেল ওর কোটের ভিতর। পিছনের তিনজন লোক ঝপ করে বসে পড়ল একসঙ্গে। পরমুহূর্তে হাতটা বের করে আনল। ইসমাইল কোটের ভিতর থেকে, হাতে পিস্তল। ঠিক সেই সময় দুপ করে আওয়াজ হলো একটা এপাশ থেকে, মৃদু। একটা গর্ত দেখা দিল ইসমাইলের কোটে। বাম পাশে, বুকপকেটের ঠিক নিচে। কেঁপে উঠল ওর শরীরটা চমকে ওঠার ভঙ্গিতে, তারপর এলোপাতাড়ি পা ফেলে দুপা সামনে এগিয়ে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে। চলন্ত ট্রাভেলেটার বয়ে নিয়ে এল লাশটা, ধাক্কা খেলো সেটা রানার গায়ে।
যাদুমন্ত্রের মত কাজ করল রানার মধ্যে মৃতদেহের স্পর্শটা। টলতে। টলতে উঠে দাঁড়াল সে, ব্যথায় কুঁচকে গেছে মুখ, দাতে দাঁত চেপে রেখেছে শক্ত করে। পিস্তল নেই রানার সাথে, গোপনে ওটাকে কাস্টমস ব্যারিয়ার পার করবার জন্যে পুরে দিয়েছে সুটকেসের তলার এক গোপন কম্পার্টমেন্টে। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় খুনীর পেছনে ধাওয়া করা ঠিক হবে কি হবে না ভেবে চিন্তে-বুঝে নেয়ার আগেই টলতে টলতে এগোল সে ইমিগ্রেশনে যাওয়ার প্ল্যাটফর্মের দিকে। বমি আসছে রানার, মাথা ঘুরছে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে এগোচ্ছে সে, মনে হচ্ছে দুলছে সবকিছু, ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না চোখে। থেমে দাঁড়িয়ে চট করে একহাতে চোখ মুছল রানা। দেখল, আসলে রক্তে বুজে গেছে ওর চোখ। মেঝেতে পড়ে কেটে গেছে কপালের একপাশ। রুমাল বের করে বার দুয়েক মুছতেই আবার পরিষ্কার হয়ে গেল ওর দৃষ্টি। অনুভব করল বুকের কাছে,ব্যথাটা কমে আসছে দ্রুত।
সমস্ত ব্যাপারটা ঘটে যেতে লাগল বড়জোর দশ সেকেন্ড, কিন্তু। ইতিমধ্যেই বেশ ভিড় হয়ে গেছে লাশটা ঘিরে। প্লেনের যাত্রী, পিছনের সেই তিনজন লোক, সেই সঙ্গে আরও কয়েকজন হাজির হয়ে গেছে যেন মাটি। ফুড়ে। জটলা হবে, হাঁকডাক হবে, এক-আধজন মহিলা চেঁচিয়ে উঠবে ভয়ে, এখন কি করতে হবে বুঝে উঠতে পারবে না কেউ প্রথমটায়–এই-ই নিয়ম, সেই ফাঁকে গা ঢাকা দেবে খুনী।
চোখ তুলেই দেখতে পেল রানা লোকটাকে। ইমিগ্রেশনে যাবার প্ল্যাটফর্মের অর্ধেকের বেশি চলে গেছে সে, স্ট্র্যাপ ধরে ব্যাগটা ঝোলাতে। ঝোলাতে হেলেদুলে হাটছে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। এদিকে কি ঘটে গেছে যেন টেরও পায়নি। সহজ ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে, কোন ব্যস্ততা নেই। লোকটার আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক হলো রানা, ওর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কেউ কোন প্রমাণ খাড়া করতে পারবে না, কাজেই এই লোকটা হাতছাড়া হয়ে গেলেই ইসমাইলের হত্যার সমস্ত সূত্র ছিন্ন হয়ে যাবে।
দৌড়াতে শুরু করল রানা।
ট্র্যাভেলেটারের মাঝামাঝি পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল রানা। পিছনে পায়ের। শব্দে সই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে লোকটা, এক ঝাঁকিতে ব্যাগটা বগলের নিচে নিয়ে এসে ডান হাতটা পুরে দিয়েছে ভেতরে। নিরস্ত্র অবস্থায় নিশ্চিত খুনীর পিছু ধাওয়া করা যে কতখানি বোকামি, বুঝতে পারল রানা মুহূর্তে। পরিষ্কার। বুঝতে পারল, কোন দ্বিধা করবে না লোকটা গুলি করতে, আগামী কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ইসমাইলের সাথে মোলাকাত হবে ওর পরপারে। ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল রানা মেঝের ওপর, এমনি সময়ে দেখল সামান্য একটু সরে। গেল পিস্তলের মুখ, লোকটার দৃষ্টিও রানার ওপর থেকে সরে সামান্য একটু বায়ে স্থির হয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। পিছন ফিরে না চেয়েও রানা বুঝতে পারল মৃতদেহের কাছে দাঁড়ানো লোকগুলো দৌড়োতে দেখে নিশ্চয়ই ইসমাইলকে ছেড়ে ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে, এবং তাই দেখে দ্বিধায় পড়েছে। খুনী।