ইরিন আসলে সবাইকে ভালবাসে, মেজর মাসুদ রানা। আশা করি আহত বোধ করবেন না এ খবরে।
না, না। আহত হওয়ার কি আছে? একটা বিশেষ বয়সের সব মেয়েই তাই করে।
প্রশংসার দৃষ্টিতে চাইল মাগেনখেলার রানার দিকে। আশ্চর্য তীক্ষ্ণ। আপনার বোধশক্তি!
এর মধ্যে তীক্ষ্ণতাটা কোথায় বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল রানা কিছুক্ষণ। তারপর ইরিনের দিকে ফিরে নরম গলায় ডাকল, ইরিন?
উত্তর দিল না ইরিন। মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে, একটু নড়েচড়ে আরও ভাল করে মাথা গুজল রানার ঘাড়ে, চোখদুটো শক্ত করে টিপে বন্ধ করে রেখেছে। হাসির মধ্যে এতই সহজ সরল নিষ্পাপ একটা তৃপ্ত ভাব দেখতে পেল রানা যে কেন যেন নিজেকে ঠগবাজ মত মনে হলো ওর।
আবার চেষ্টা করে দেখল রানা। ইরিন, আমার মনে হয় তোমার চোখ। দুটো খুব সুন্দর। দেখি তো সত্যি কিনা?
কথাটা ভেবে দেখল ইরিন চোখ বুজেই, হাসল আবার, তারপর রানার কোলের ওপর সোজা হয়ে বসে হাত দুটো সোজা রেখে দুই হাতে ধরল রানার দুই কাঁধ , চোখ দুটো বড় বড় করে চাইল রানার চোখে-ঠিক বাচ্চা মেয়ের মত।
অপূর্ব দুটো আয়ত বেগুনী চোখ, চকচক করছে–কিন্তু ভাল করে লক্ষ করতেই টের পেল রানা, দৃষ্টিটা শূন্য। চকচকে, উজ্জল ভাবটা আসলে বাইরের ব্যাপার, তার পেছনেই আশ্চর্য এক ভাবলেশহীন অন্তঃসারশূন্যতা। আস্তে করে ওর ডান হাতটা সরাল রানা কাঁধ থেকে, কোটের আস্তিনটা তুলে। ফেলল কনুই পর্যন্ত। ক্ষতবিক্ষত হাত। হাইপোডমিক সূচের অসংখ্য খোঁচায়। দগদগে ঘায়ের মত দেখাচ্ছে। হাসি মুছে গেছে ইরিনের মুখ থেকে, নিচের ঠোঁটটা কাপল একটু, ভয়ে ভয়ে চাইল রানার মুখের দিকে–যেন আশা করছে। এক্ষুণি বকবে ওকে রানা। ঝট করে কোটের হাতা নামিয়ে দিল, পরমুহূর্তে দুই হাতে রানার গলা জড়িয়ে ধরে ফোপাতে শুরু করল। এমনভাবে কাঁদছে, যেন ওর বুক ভেঙে গেছে পুত্রশোকে। ওর পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল রানা, ওর মাথার ওপর দিয়ে চাইল মাগেনথেলারের দিকে।
এবার বুঝতে পারছি আমাকে আপনার বাসায় নিয়ে আসবার কারণ।
ঠিকই বুঝতে পেরেছেন, বলল মাগেনথেলার। আমার বিশ্বস্ত সহকর্মীদের বিষয়টা জানানো আমি কর্তব্য বলে মনে করি।
ডি গোল্ড জানেন?
অ্যামস্টার্ডামের প্রত্যেক সিনিয়র পুলিস অফিসারই জানেন, বলল মাগেনথেলার সহজ কণ্ঠে। ইরিনের দিকে চাইল। ইরিন?
কোন জবাব না দিয়ে আরও আঁকড়ে ধরল ইরিন রানাকে। দম বন্ধ হওয়ার যোগাড় হলো রানার। এবার একটু কড়া গলায় ডাকল মাগেনথেলার, ইরিন? ঘুমোতে যাও। তুমি জানো ডাক্তার কি বলেছে। সোজা বিছানায় গিয়ে ঢোকো–যাও, লক্ষ্মী।
না, ফুঁপিয়ে উঠল ইরিন। ঘুম আসছে না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গলার স্বর উঁচু করল ইন্সপেক্টর মারগ্রিয়েট!
ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এই ডাকের জন্যেই দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়েছিল–এমনি ভাবে, ঘরে ঢুকল খোদাতালার আশ্চর্য এক সৃষ্টি। এত মোটা মেয়েমানুষ জীবনে দেখেনি রানা। দুটো রানা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে। দুহাত বাড়ালেও বেড় পাবে না। অবিকল ইরিনের পুতুলের মত জামা-কাপড়। পরা। লাল ফিতে দিয়ে পিগটেল বাধা লম্বা চুল গলার দুপাশ দিয়ে বিশাল বুকের ওপর লুটাচ্ছে। বুড়ি। কমপক্ষে সত্তর বছর বয়স হবে। গালের এবং হাতের ভাজ দেখে বোঝা যাচ্ছে, আরও মোটা ছিল, শুকিয়ে এই হাল হয়েছে। বেচারীর। চেহারা, বয়স, চুলের লাল ফিতে আর রঙেচঙে জামা কাপড়ে মেয়েলোকটাকে রীতিমত বিদঘুটে লাগল–রানার চোখে। কিন্তু মাগেনথেলারের কাছে যে মোটেই বিসদৃশ লাগছে না বোঝা গেল তার সহজ ভঙ্গিতে ইরিনকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে চোখের ইশারা দেখে।
বিশাল বপু নিয়ে সহজ ভঙ্গিতে এগিয়ে এল মারগ্রিয়েট, রানার প্রতি ছোট্ট একটা নড় করে হাত রাখল ইরিনের কাঁধে। চট করে মাথা তুলল ইরিন, মুহূর্তে কান্না ভূলে হেসে উঠল ঝিক করে, রানার গলা ছেড়ে দিয়ে উঠে। দাঁড়াল। মাগেনথেলারের হাত থেকে পুতুলটা নিয়ে চুমো খেল ওর গালে, রানার চেয়ারের সামনে এসে রানার গালেও চুম খেল একটা, তারপর নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে হেলেদুলে ওর পেছনে পেছনে চলে গেল মারগ্রিয়েট। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইন্সপেক্টরের দিকে ফিরল রানা।
আগেই সাবধান করা উচিত ছিল আপনার, অনুযোগের সুরে বলল। রানা। ইরিন আর মারগ্রিয়েট–দুজনের ব্যাপারেই। চমকে গিয়েছি একেবারে। কে মহিলা–মানে, মারগ্রিয়েটের কথা জিজ্ঞেস করছি-নার্স?
যাইডার যীর হাইলার দ্বীপে ওর বাড়ি। বহু পুরানো লোক…আমি ছোট থাকতে কাজে লেগেছিল আমাদের বাড়িতে, মানে বাপের বাড়িতে। বছর। খানেক আগে আবার এসে হাজির কাজ দাও। ইরিনের জন্যে রেখে দিলাম। ওকে। কাপড়চোপড়ে পুরানো আমলের ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছে, ওই দ্বীপের। সবাই তাই শহরে দেখতে একটু উদ্ভটই লাগে, কিন্তু ইরিনের ব্যাপারে দারুণ কাজ দিচ্ছে বুড়ি।
আচ্ছা। বলল রানা। আর ইরিন?
আট বছর ওর বয়স। গত পনেরো বছর ধরে আট বছরেরই রয়ে গেছে। চিরকাল ওই আট বছরই থাকবে। আমার নিজের মেয়ে না–হয়তো অনুমান করেছেন; কিন্তু নিজের মেয়ের চেয়ে কমও না। আমার বড় ভাইয়ের পালিতা কন্যা। একটা ডাচ অয়েল কোম্পানীতে সিকিউরিটি অফিসার ছিল আমার বড় ভাই। ওর স্ত্রী মারা গেছে কয়েক বছর আগেই, গত বছর ও আর আমার স্ত্রী মারা গেছে একটা মোটর দুর্ঘটনায়। কে নেবে ইরিনকে? সাত-পাঁচ ভেবে আমিই রেখে দিলাম। প্রথমটায় দায়িত্ব আর ঝামেলা ঘাড়ে করতে চাইনি-এখন এমন দাঁড়িয়েছে, ওকে ছাড়া বাঁচব বলে মনে হয় না। মানসিক বয়স বাড়বে না ওর কোনদিন।