অর্থাৎ, আপনি আমাকে জানাতে চান, যে এই গোপন দলটাকে ধ্বংস করার ব্যাপারে আমার চেয়ে কোন অংশে কম আগ্রহী নন আপনারা–যে, একই শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করছি আমরা; আমাদের আক্রমণের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন?
ঠিকই ধরেছেন। এক এবং অভিন্ন।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য?
আমি চেয়েছি কর্নেল ডি গোন্ডের সাবধানবাণীটা আপনাকে দিয়ে আরও গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করাতে। ওরা ঠিক কতটা রুথলেস, কতখানি ভয়ঙ্কর। দেখাতে চেয়েছি আমি আপনাকে মরচুয়ারীতে নিয়ে গিয়ে। যদি ওদের বেশি কাছে যান, যদি বেশি বিরক্ত করেন কি বলব, এখনও কয়েকটা সীট খালি। আছে মরচুয়ারীতে।
লম্বা করে টান দিল রানা সিগারেটে। বাড়ির ভিতরে একটা টেলিফোন বেজে উঠল। বিড়বিড় করে ক্ষমা চেয়ে দ্রুতপায়ে চলে গেল মাগেনথেলার। ভিতরে। দরজাটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা দরজা খুলে গেল, সুন্দরী এক যুবতী ঢুকল ড্রইংরূমে। লম্বা একহারা চেহারা, বয়স বড়জোর বিশ কি বাইশ। একটা ড্রাগন আঁকা রঙচঙে হাউজ কোট দিয়ে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা। কুচকুচে কালো চুল মেয়েটার, ডিম্বাকৃতি মুখ, আয়ত চোখ দুটো বেগুনী রঙের। উঠে দাঁড়াল রানা।
হ্যালো। আমি মাসুদ রানা। আর কি বলবে বুঝে পেল না সে।
হঠাৎ ঘরে ঢুকে মেয়েটাও যেন একটু হতচকিত হয়ে পড়ল। চট করে। বুড়ো আঙুলটা মুখে পুরে চুষে নিল কয়েক সেকেন্ড। তারপর কিক করে। হাসল। পরিপাটি ঝকঝকে একসারি দাঁত।
আমি ইরিন। ভাল ইংরেজি বলতে পারি না কিন্তু। মিষ্টি গলায় বলল মেয়েটা।
দুপা এগিয়ে হাত বাড়াল রানা হ্যাঁন্ডশেকের জন্যে। কিন্তু হাতটা ধরবার। কোন লক্ষণ দেখা দিল না মেয়েটার মধ্যে। তর্জনী কামড়ে ধরে হেসে উঠল খিলখিল করে। লাল হয়ে উঠেছে লজ্জায়। এত বড় একটা মেয়ের এই রকম ব্যবহারে একেবারে থতমত খেয়ে গেল রানা। স্বস্তির খাস ফেলল পাশের ঘরে রিসিভার নামিয়ে রাখার আওয়াজ হতেই।মাগেনখেলার এসে ঢুকল ড্রইংরূমে।
রুটিন কল। জরুরী কিছু না, এয়ারপোর্ট থেকে মেয়েটাকে দেখে কথার মাঝখানেই থেমে গেল মাগেনথেলার, মৃদুহেসে এগিয়ে এসে সস্নেহে হাত রাখল ইরিনের কাঁধে। পরিচয় হয়েগেছে মনে হচ্ছে?
পরিচয় পর্বের মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিলাম বলতে বলতে থেমে গেল রানা। দেখল, মাগেনথেলারের কানে কানে কথা বলছে ইরিন ফিসফিস করে, চকচকে চোখে রানার দিকে চাইছে বাকা দৃষ্টিতে। মদ হেসে মাথা ঝাঁকাল মাগেনথেলার, ছুটে বেরিয়ে গেল ইরিন ঘর থেকে। হতভম্ব রানার দিকে চেয়ে আবার হাসল মাগেনখেলার, ম্লান হাসি।
এক্ষুণি ফিরে আসবে আবার, দেখবেন। অপরিচিত লোকের সামনে। প্রথমটায় লজ্জা পায় ও একট, কিন্তু সহজ হতেও সময় লাগে না মোটেই।
ঠিকই। দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ফিরে এল ইরিন। কোলে একটা বড়সড় পুতুল। পুতুলটা এত সুন্দর করে তৈরি যে প্রথম দেখলে মনে হয় সত্যিই জ্যান্ত বাচ্চা বুঝি। প্রায় তিনফুট লম্বা, মাথায় সাদা একটা টুপি, টুপির নিচে কোঁকড়া সোনালী চুল দেখা যাচ্ছে, পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা একটা সিল্কের পোশাক পরা, চমৎকার এমব্রয়ডারি করা বডিস গায়ে। শক্ত করে ধরে আছে ইরিন পুতুলটাকে, যেন সত্যিকারের বাচ্চা, ঢিল দিলে পড়ে যাবে। হাত বাড়িয়ে। কাছে টেনে নিল মাগেনখেলার ইরিনকে, একহাতে জড়িয়ে ধরে পরিচয় করিয়ে দিল, এটা আমার মেয়ে, ইরিন। আর ইনি আমার এক বন্ধু বাংলাদেশের লোক, মেজর মাসুদ রানা।
এবার অসঙ্কোচে এগিয়ে এল ইরিন, হাত বাড়াল মৃদু হেসে।
হাউ ডু ইউ ডু, মেজর রানা?
ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে রানাই বা কম যাবে কেন, স্মিত হাসি হেসে বো করল সে সামান্য, হাতটা ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল, মিস মাগেনথেলার। মাই প্লেযার।
মাই প্লেযার। বলেই কথাটা বলা ঠিক হলো কিনা জানার জন্যে সপ্রশ্ন। দৃষ্টিতে চাইল বাপের দিকে।
ইংরেজি ভদ্রতার সাথে খুব একটা পরিচয় নেই ইরিনের, কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল মাগেনথেলার। তারপর শশব্যস্ত হয়ে বলল, আরে! দাঁড়িয়ে কেন? বসুন, বসে পড়ুন। বলে নিজেই ধপাস করে বসে পড়ল চেয়ারে, তুলে নিল ব্র্যান্ডির গ্লাসটা।
রানাও বসল। পুতুল কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইরিন, ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছে সে রানার মুখের দিকে। অস্বস্তি বোধ করতে, শুরু করল রানা। এই অস্বাভাবিক পরিবেশে ঠিক কি করা উচিত বুঝতে না পেরে ক্রমেই বাড়ছে। অস্বস্তিবোধ। মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল, তুমি বসবে না?
চকচকে চোখে চাইল ইরিন বাপের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল রানার কথায়, তারপর পুতুলটা বাপের হাতে দিয়ে সোজা এসে চড়ে বসল রানার। কোলে। একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রানা। কিন্তু কোন রকম ভাবান্তর। নেই ইরিনের মুখে, যেন এটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক কাজ হয়েছে, এমনি ভঙ্গিতে একহাতে জড়িয়ে ধরল রানার গলা, তারপর মিষ্টি করে হাসল চার ইঞ্চি দূর থেকে সোজা রানার চোখের দিকে চেয়ে। রানাও হাসবার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটা হাসির চেয়ে ভ্যাংচানোর মতই দেখাল বেশি।
উজ্জ্বল চোখে খানিকক্ষণ রানাকে দেখার পর ঘোষণা করল ইরিন, তুমি খুব ভাল। তোমাকে আমি ভালবাসি।
আমিও তোমাকে ভালবাসি, ইরিন, বলল রানা। কতটা ভালবাসে বোঝাবার জন্যে ওর পিঠে মৃদু চাপড় দিল দুটো। হাসিমুখে চোখ বন্ধ করল ইরিন, মাথাটা রাখল রানার কাঁধে। ওর মাথার ওপর দিয়ে মাগেনহেলারের দিকে চাইল রানা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। মলিন হাসি হাসল মাগেনথেলার। হাসিতে ঝরছে দুঃখ।