আমরাও চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বোতলে কারও আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি••এমন কি এই ছেলেটিরও না। ব্যাচ নাম্বার মিলিয়ে যে খোঁজ করব, তারও উপায় ছিল না। লেবেলই ছিল না বোতলে।
এবার ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় চলে এল ওরা। মার্বেল পাথরের মত দেখতে একটা সাদা স্ল্যাবের ধারে দাঁড়িয়ে মুখের কাপড় সরাল এবার মাগেনথেলার একটা লাশের। অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে মনে হচ্ছে ঠিক ঘুমিয়ে আছে। একগোছা সোনালী চুল লেপটে আছে চিবুকের কাছে।
সুন্দর না? জিজ্ঞেস করল মাগেনথেলার। ওর কণ্ঠস্বরে শীতল একটা উন্মা টের পেল রানা। একটী রেখা নেই, নিপাপ, পবিত্র মুখটা। রোজমেরী ডুনিং। আমেরিকান। বয়স–ষোলো। আর কিছুই জানা যায়নি এর সম্পর্কে।
কি হয়েছিল?
সাততলার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিল নিচে ফুটপাথের ওপর।
চট করে হোটেলের ফ্লোর ওয়েটারের কথা মনে পড়ে গেল রানার। হয়তো ওকেও পাওয়া যাবে এই মরচুয়ারীর কোন না কোন স্ল্যাবের ওপর। জিজ্ঞেস করল, নিজেই, নাকি ধাক্কা দিয়ে সাহায্য করেছিল কেউ?,
নিজেই। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হচ্ছে হিপ্লিদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল মেয়েটা, বাডির জন্যে মন টেনেছিল, হঠাৎ ছাতের প্যারাপেটের। ওপর লাফিয়ে উঠে উড়ে চলে যেতে চেয়েছিল মায়ের কাছে। ভাগ্যিস ফুটপাথের ওপর তখন আর কেউ ছিল না। আরও দেখবেন কয়েকটা? কাল। রাতে কার্লটন হোটেলে মারা পড়েছে একটা জাংকি দেখবেন ওটাকে?
যথেষ্ট হয়েছে, বলল রানা। এসব আমার কাছে নতুন নয়। এই একই দৃশ্য দেখে এসেছি আমি ঢাকার মর্গে। তারচেয়ে কোথাও বসে একটোক বাভি খাওয়া যাক বরং•• কি বলেন?
ঠিক বলেছেন। এসব দেখার চেয়ে ব্র্যান্ডি অনেক ভাল। হাসল। মাগেনুথেলার, কিন্তু সে হাসিতে রসকষ নেই-নিপ্রাণ, নিষ্প্রভ। আমার বাসায় চলুন। বেশি দূরে না। আপনাকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার আরও একটা কারণ আছে।
কারণ?
চলুন, দেখবেন।
বাইরে বেরিয়ে রানা দেখল, আঁধার হয়ে এসেছে আকাশটা আজ সকাল সকালই। পুবদিকটা ধূসর মত দেখা যাচ্ছে। খানিক বাদেই বৃষ্টি নামবে বড় বড় ফোঁটায়। সারা আকাশ জুড়ে মলিন বিষণ্ণতা। মনে মনে ভাবল সে, বহুদিন পর মনের ভাবের সঙ্গে প্রকৃতির মিল পাওয়া গেল। ভারাক্রান্ত মনে কালো ওপেলে গিয়ে উঠল সে মাগেনথেলারের পিছু পিছু।
.
০৫.
ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের ড্রইংরূমে ঢুকেই মনের বিষণ্ণ ভাবটা কেটে গেল। রানার। সেন্ট্রাল হিটেড ঘরের সবখানে উজ্জল, খুশি খুশি রঙ। জানালার কাঁচে বিড়বিড় করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, কুলকুল করে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে কাঁচের ওপর দিয়ে। সব শীতলতা, সব মালনতা গলে যাচ্ছে, ধুয়ে মুছে। সাফ হয়ে যাচ্ছে এ ঘরের বাইরে ঢুকতে পারছে না ভিতরে। ভারী ডাচ ফার্নিচারে সুন্দর করে সাজানো ড্রইংরূম, নরম গদি আটা আমচেয়ার রয়েছে। কয়েকটা। রঙচঙে পুরু কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে বসে পড়ল রানা। একটা চেয়ারে। ঘরের এককোণে বড়সড় একটা লিকার কাবার্ডের সামনে। দাঁড়িয়ে কোন বোতলটা বের করবে সে ব্যাপারে মনস্থির করবার চেষ্টা করছে মাগেনথেলার। খানিক ইতস্তত করে একটা তিনকোনা বোতল থেকে দুটো গ্লাসে প্রায় তিন ইঞ্চি পরিমাণ সোনালী তরল পদার্থ ঢেলে নিয়ে চলে এল। রানার সামনে। একটা টিপয়ের ওপর রানার গ্লাসটা নামিয়ে দিয়ে নিজেরটা হাতে নিয়ে বসল মুখোমুখি একটা আর্মচেয়ারে।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব আপনাকে, মেজর মাসুদ রানা। আপনার। সম্পর্কে আমরা যতদূর জানি, আপনি এসপিয়োনাজের লোক, দূধর্ষ এক স্পাই…ড্রাগস তো আপনার লাইন নয়? এসবে তো আপনার আগ্রহী হওয়ার। কথা নয়? আপনি এর মধ্যে এলেন কি মনে করে?
আমি এই লাইনের লোক নই, খবরটা ঠিকই শুনেছেন। আমার চীফ যখন প্রথম আমাকে এ ব্যাপারে কাজ করবার প্রস্তাব দেন, আমি অত্যন্ত। বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম সে প্রস্তাব। এই একই যুক্তিতে। কিন্তু আমার বস্ যখন আমাকে সাথে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে গিয়ে লাশগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, যখন নিজ চোখে দেখলাম সারি সারি বাঙালী যুবক-যুবতীর মৃতদেহ, তখন আর স্থির থাকতে পারলাম না। কিছুতেই। কোন দেশপ্রেমিক স্থির থাকতে পারে না সে দৃশ্য দেখে। আমিও। পারিনি। আমার মনে হয়েছে, কেবল অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যই নয়, ভয়ঙ্কর ধরনের মস্তিষ্কবিকৃতি রয়েছে; তরুণদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড কোন আক্রোশ আর প্রতিশোধের মনোভাব রয়েছে এদের লীডারের মধ্যে। বিকৃত এক ধরনের আনন্দ লাভ করছে লোকটা কাঁচা বয়স, বিক্ষোভ আর হতাশার শিকার। হাজার হাজার সম্ভাবনাময় তরুণ তরুণীর চরম সর্বনাশ করে। ধ্বংসযজ্ঞে নেমেছে যেন এক নির্মম ম্যানিয়াক। মনস্থির করতে আর কোন কষ্ট হয়নি আমার।
রানার বক্তব্যটা বেশ কিছুক্ষণ নিজের মনে নেড়েচেড়ে বুঝে দেখল মাগেনথেলার। চোখ বুজে মাথা ঝাঁকাল বার কয়েক, তারপর বলল, ঠিক বলেছেন।
আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, বলল রানা মৃদু হেসে। আমাকে মরচুয়ারী থেকে ঘুরিয়ে আনবার পেছনে নিশ্চয়ই আপনার কোন উদ্দেশ্য রয়েছে। কিছু একটা বোঝাতে চাইছেন আপনি আমাকে। কি সেটা?
একটা নয়, কয়েকটা জিনিস বোঝাতে চেয়েছি আমি আপনাকে। ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে একটা সাইড টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল সে গ্লাসটা। রানাকে সিগারেট ধরাবার সময় দিয়ে শুরু করল প্রথমত আমি আপনাকে জানাতে চাই, সমস্যাটা আপনাদের ওখানে ঠিক যতখানি, আমাদের এখানে তার চেয়ে কম প্রকট নয়। বরং বেশি। সিটি মরচুয়ারীতে ওই রকম আরও অন্তত বিশটা লাশ রয়েছে। সব হেরোইনের শিকার। সব সময় এত বেশি হয়। না, মৃত্যুর হারটা জোয়ার ভাটার মত কমে বাড়ে, ইদানীং একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। কচি কচি ছেলেমেয়েদের লাশই বড় কথা নয়, আরও কত হাজার নেশাগ্রস্ত যুবক যে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, তার হিসেব কোথাও লেখা নেই।