অতীত ইতিহাস ঘাটতে আমার ভাল লাগে না।
সেটাই স্বাভাবিক। ঘন ঘন মাথা দোলাল কর্নেল। তবে একটা কথা আপনাকে আমি বলব, মেজর রানা। পৃথিবীর সেরা পুলিস ফোর্সও কোন না কোন সময় দুর্লংঘ প্রাচীরের সম্মুখীন হতে পারে। আমরা শ্রেষ্ঠ-সে দাবি করছি না, কিন্তু তেমনি বাধার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। শুধু একটা লীড দিন। আমাদের, সামান্য একটা ছিদ্র দেখিয়ে দিন; তারপর দেখুন আমাদের ক্ষমতা। হয়তো এ ব্যাপারে সাহায্য করবার মত কোন প্ল্যান বা তথ্য রয়েছে আপনার। হাতে?
এত তাড়াতাড়িই? হাসল রানা। পকেট থেকে ফ্লোর ওয়েটারের কাছে। পাওয়া স্ক্র্যাপ প্যাডের পাতাটা বের করে এগিয়ে ধরল কর্নেলের দিকে। মাত্র গতকাল বিকেলে পৌঁছেচি আমি এখানে এসে। আচ্ছা, দেখুন তো, এই অক্ষর আর নম্বরগুলোর কোন অর্থ আপনার মাথায় খেলে কিনা?
কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে কটমট করে চাইল কর্নেল ওটার দিকে, যেন ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে নম্বরগুলোকে; উজ্জ্বল ডেস্কল্যাম্পের আলোর নিচে উল্টেপাল্টে দেখল কাগজটা, তারপর নামিয়ে রেখে মাথা নাড়ল। নাহ।
সত্যিই কোন মানে আছে কিনা বের করার ব্যবস্থা করতে পারেন?
তা পারা যায়। এসব ব্যাপারে যোগ্য লোক আছে আমাদের। আগামী কাল জানাতে পারব আপনাকে। যাই হোক, কোথায় পেলেন এটা?
একজন দিয়েছে।
তার মানে কারও কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন আপনি এটা।
দুটো কথায় তফাৎ আছে?
অবস্থা বিশেষে আকাশ পাতাল তফাৎ হতে পারে, মেজর রানা। ডেস্কের ওপর দিয়ে ঝুঁকে এল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড বক্তব্যের গুরুত্ব বোঝাবার জন্যে। শুনুন মেজর রানা, আমরা আপনার টেকনিকের কথা জানি। আমরা জানি, মানুষকে কিভাবে বেকায়দায় ফেলে কাজ উদ্ধার করেন; জানি, প্রয়োজন মনে করলে আইনের বেড়া ডিঙিয়ে যেতে আপনার বাধে না…
এসব কী বলছেন, কর্নেল।
যা বলছি, জেনেশুনেই বলছি। আমরা জানি, আপনার এই মেথডে অনেক দ্রুত কাজ হতে পারে, কিন্তু এটা আত্মহত্যারই নামান্তর। প্রতিপক্ষকে চরম ভাবে উত্যক্ত করলে, তাকে একের পর এক অসুবিধেয় ফেললে, প্রোতভাকেট করলে, শো-ডাউনটা এগিয়ে আসে কয়েক ধাপ সামনে, তা ঠিক; কিন্তু আমার একান্ত অনুরোধ, মেজর রানা, দয়া করে এখানে বেশি লোককে প্রোভোকেট করতে যাবেন না। রিপিট করছি–এটা আত্মহত্যারই নামান্তর। অ্যামস্টার্ডামে খালের সংখ্যা অনেক।
ঠিক আছে, কর্নেল। কাউকে প্রোডোক করব না। সাবধানে থাকব। যতদূর সম্ভব।
দ্যাটস গুড। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল কর্নেল। এবার মাগেনথেলার হয়তো আপনাকে খানিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু দেখাতে চাইবে।
বেশ অনেক কিছুই দেখাবার রয়েছে মাগেনথেলারের, বোঝা গেল। মানিক্সস্ট্রাটের পুলিস হেডকোয়ার্টার থেকে, মাগেনথেলারের কালো ওপেলে। চড়ে সিটি মরচুয়ারীতে পৌঁছল রানা। বিশাল এক ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকল অ্যাটেনড্যান্ট আর ইন্সপেক্টরের পিছু পিছু। ঘরের মাঝখানে লাইন দিয়ে সাজানো রয়েছে দুই সারি সাদা স্ল্যাব, দুটো মাত্র খালি-বাদবাকি সবকটার। ওপর সাদা কাপড় ঢাকা লাশ শুয়ে আছে টান টান হয়ে। চারপাশের দেয়াল। জুড়ে ফাঁইলিং ক্যাবিনেটের মত অসংখ্য স্টীলের ড্রয়ার। রানা জানে, এইসব। ড্রয়ারের মধ্যে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে লাশ, রেফ্রিজারেটেড। ডিজিনফেক ট্যান্টের তীব্র গন্ধে নাক কুঁচকাল সে। ইন্সপেক্টরের ইঙ্গিতে দেয়ালের গায়ের একটা স্ল্যাব টেনে বের করল অ্যাটেন্যান্ট ক্যাচ সরিয়ে। সাদা কাপড়ে ঢাকা রয়েছে লাশটা আপাদমস্তক।
ক্রোকুইস্কেড ক্যানেলে পাওয়া গেছে এটা, বলল মাগেনখেলার চেষ্টাকৃত নিরুত্তাপ কণ্ঠে। হ্যাঁন্স গার্বার। বয়স উনিশ। না দেখাই ভাল, বেশ। কয়েকদিন পানিতে ছিল বলে ওটা আর দেখার যোগ্য নেই। তবে হাতটী। দেখতে পারেন।
চাদরটা সামান্য উঁচু করতেই একটা ফোলা হাত দেখতে পেল রানা। মনে হচ্ছে কেউ যেন মোরব্বার মত কেচেছে হাতটা কাটাচামচ দিয়ে, কিংবা স্পাইক লাগানো জুতো পায়ে আচ্ছামত মাড়িয়েছে ওটাকে। লাল, নীল, সবুজ-নানান রঙ দেখা যাচ্ছে ক্ষতচিহ্নগুলোর আশে পাশে। কোন মন্তব্য না; করেই হাতটা ঢেকে দিয়ে পিছন ফিরল মাগেনথেলার। হড়হড় করে ঢুকিয়ে। দিল অ্যাটেনড্যান্ট স্ল্যাবটা।
খানিক বাঁয়ে সরে আর এক সারি স্ল্যাবের সামনে দাঁড়াল মাগেনথেলার। বলল, এরও মুখটা দেখাতে চাই না আমি আপনাকে। একশ বছরের এক তরুণের মুখ যদি সত্তর বছরের বুড়োর মত দেখতে হয়, সেদিকে তাকানো যায় না। অ্যাটেনড্যান্টের দিকে ফিরল। তেষটি নম্বরটা খোলো। কোথায় পাওয়া গিয়েছিল এটাকে?
উস্টারহুকে। একটা কয়লার বার্জে। ক্যাচ সরিয়ে হ্যাঁচকা টান দিল লোকটা হ্যাঁনডেল ধরে।
মাথা ঝাঁকাল মাগেনথেলার। ঠিক। সঙ্গে বোতল ছিল একটা। খালি বোতল। জিনের। আধ বোতল জিন পাওয়া গিয়েছিল ওর পেটে। হেরোইনের। সঙ্গে জিনের সম্পর্কটা জানা আছে আপনার? রানাকে মাথা ঝাঁকাতে দেখে সাদা কাপড় সরিয়ে এরও হাতটা দেখাল সে কয়েক সেকেন্ড। দার্শনিক ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল, হত্যা-না আত্মহত্যা?
একটু খোঁজ নিলে হয়তো বের করতে পারতেন আসল ব্যাপারটা।
কিভাবে? বোতলটা কার কেনা সে খবর সংগ্রহ করে?
হ্যাঁ। ওর নিজের কেনা হলে এটা হবে হয় আত্মহত্যা, নয়তো দুর্ঘটনা। কেউ যদি আধ বোতল জিন ওর হাতে তুলে দিয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে এটা হত্যা। ঠিক এই ধরনের একটা কেস হয়েছিল মাস ছয়েক আগে আমাদের বাংলাদেশে চট্টগ্রামে। তিনদিনের মধ্যে অ্যারেস্ট করেছিল পুলিস। খুনীকে।