ওদের এফিশিয়েনসি লেভেল খুব একটা উঁচু বলে মনে হয়নি আমার কাছে।
ঠিক বলেছেন। কথাটা পছন্দ হয়েছে কর্নেলের। যাই হোক, এ খবরটা বের করতে আমার বেশি সময় লাগবে না। আপনার আর কোন তথ্য দরকার?
না। আপাতত এই। ধন্যবাদ।
আর একটা ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করলাম না আমাদের দুজনের কেউই।
বলুন। কোন ঘটনা?
সাততলার ফ্লোর ওয়েটারের কথাটা। দুধে ধোয়া লোক নয়–বেশ। কয়েকবার মোলাকাত হয়েছে ওর আমাদের সঙ্গে, আমাদের ফাইলের দুটো পৃষ্ঠা জুড়ে ওর নানান কীর্তিকলাপের বর্ণনা রয়েছে। এই লোকটাও আপনার। নিজস্ব লোক নয়তো?
বলেন কী, কর্নেল। আকাশ থেকে পড়ল রানা।
না, না। আমি একবারও ভাবিনি ও আপনার লোক। বরং ভেবেছি ও আপনার বিরুদ্ধ পক্ষের লোক হওয়া সম্ভব। জানেন, ঘাড় মটকে হত্যা করা হয়েছে লোকটাকে?
তাই নাকি? বেকায়দা পড়ে গিয়েও ঘটতে পারে ব্যাপারটা। সত্যিই, খুবই দুঃখজনক।
ব্র্যান্ডির গ্লাসটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল কর্নেল।
আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার কোনদিন, হয়নি, মেজর রানা। কিন্তু আপনার কর্মপদ্ধতির অনেক খবরই আমরা রাখি। কয়েক হাত ঘুরে হলেও আপনার সম্পর্কে অনেক কথাই এসেছে আমাদের ফাইলে। এই সুযোগে আপনাকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেব পালারমো, মার্সেই বা ইস্তামবুলে যে রীতি, চলে, অ্যামস্টার্ডামে সেটা প্রয়োগ করতে যাওয়া ভুল হবে।
আমার সম্পর্কে অনেক খবরই রাখেন দেখছি।
সেজন্যেই সাবধান করা দরকার বলে বোধ করছি। অ্যামস্টার্ডামে আমাদের সবাইকে আইনের আওতার মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। আমাকেও। আপনিও এর রাইরে নন। সরাসরি চাইল আবার সে রানার দিকে। এখানে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারবেন না আপনি।
তা তো বটেই। আমি সাবধান থাকতে চেষ্টা করব। পারস্পরিক সহযোগিতার কথাটাও মনে রাখব। এবার যে কারণে আমার এখানে আসা। কখন, কোথায় আলোচনায় বসা যায়?
কাল সকাল দশটায়। আমার অফিসে। নিরুৎসুক দৃষ্টি বুলাল কর্নেল রেস্তোরাঁর চারপাশে। এটা আলোচনার উপযুক্ত জায়গা নয়। রানাকে জ্বজোড়া উঁচু করতে দেখে বলল, গোপন আলোচনা আড়ি পেতে শোনার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে হোটেল কার্লটনের।
অবাক করলেন। মুচকে হাসল রানা।
ভারী পা ফেলে বেরিয়ে গেল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড, হাসিটা আর একটু বিস্তৃত হলো রানার। ভাবল–তাই যদি না হবে, তাহলে আর এই হোটেল বাছাই করলাম কেন? কর্নেল কি ভেবেছে না জেনেই ভুল করে ঢুকে পড়েছি। আমি বাঘের গর্তে?
.
০৪.
কর্নেল ডি গোল্ড বসে আছে টেবিলের ওপাশে নিজের সীট ভর্তি করে, এপাশে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে রানা। মস্ত বড় ঘরটা, অফিসের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ছিমছাম আমি কায়দায় সাজানো–আরাম আয়েশের কোন বন্দোবস্ত নেই। আসবাব বেশির ভাগই স্টীলের। দেয়ালের গায়ে একসারি ফাঁইলিং ক্যাবিনেট, স্টীলের টেবিলের ওপাশে গোটা কয়েক স্টীলের আলমারি। সমস্ত ঘরেই একটা কাজ কাজু ভাব। চেয়ারগুলোও বোধহয়, কর্নেলের ইচ্ছে ছিল স্টীল। দিয়ে তৈরি করবার, কিন্তু এখানে অনেক ধরনের বিশিষ্ট লোকের আগমন হয়। বলে ততদূর যেতে পারেনি–তবে চেয়ারের সীটগুলো এমনই শক্ত করে বানানো হয়েছে, যে স্টীলকেও হার মানায়। কেউ যে এখানে আরাম করে বসে। দুটো সুখ দুঃখের কথা বলবে তার উপায় নেই, কাজের কথা সেরেই বাধ্য, হয়ে উঠে পড়তে হবে চেয়ার ছেড়ে।
রানার সুবিধের জন্যেই অল্প দুচার কথার পরই কাজের কথায় চলে এল কর্নেল।
সব ধরনের ড্রাগের ব্যাপারেই আমরা আগ্রহী-ওপিয়াম, ক্যানাবিস, অ্যামফিটামিন, এল, এস ডি, এস টি পি, কোকেন, অ্যামিল অ্যাসিটেট, সব। এদের প্রত্যেকটাই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। হয় ধ্বংস করে, নয়তো মানুষকে টেনে। নিয়ে যায় ধ্বংসের মুখে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের কাজের সুবিধের জন্যে আপাতত এদের মধ্যে ভয়ঙ্করতম যেটা, সেই হেরোইনের ব্যাপারেই আমরা আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। রাজি?
রাজি। গভীর একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল দরজার কাছ থেকে। ঘাড় ফিরিয়ে না দেখল একহারা লম্বা, সুপুরুষ চেহারার এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। দরজার গোড়ায়, পরনে চমৎকার কাটের স্যুট; বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে আটচল্লিশের মধ্যে, চোখের দৃষ্টি ঠাণ্ডা, তীক্ষ্ণ, মুখে একটা অমায়িক ভাব, কিন্তু বোঝা যায় পান থেকে চুন খসলেই মুহূর্তে রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে পারে এই লোক অধঃস্তন কর্মচারীর ওপর। হ্যাঁ এক নজরেই চেনা যায় কোন পেশায়। রয়েছে লোকটা-পুলিস। শুধু পুলিস নয়, দায়িত্বপূর্ণ পদের পুলিস।
দরজা বন্ধ করে হাসিমুখে এগিয়ে এল লোকটা, হাত বাড়াল সামনের দিকে। আমি ভ্যান ডি মাগেনথেলার। আপনার কথা অনেক শুনেছি আমি, মেজর মাসুদ রানা।
কথাটা পছন্দ হলো না রানার। কোথায় ওর সম্পর্কে কি শুনেছে জানবার আগ্রহ হলো, কিন্তু আপাতত কোন মন্তব্য না করাই স্থির করে হাসল, ঝাঁকিয়ে দিল মাগেনথেলারের বাড়িয়ে ধরা হাতটা।
আনুষ্ঠানিক ভাবে পরিচয় করিয়ে দিল কর্নেল। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। হচ্ছেন আমাদের এখানকার নারকোটিক ব্যুরোর হেড। আপনার কাজে সব রকম সাহায্য করবেন ইনি। আপনার যখন যা প্রয়োজন, শুধু মুখে উচ্চারণ করবেন, প্রয়োজন হলে সাগর সেঁচে মুক্তো তুলে আনবে মাগেনথেলার আপনার জন্যে।