রানাকে পাশ কাটিয়ে প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার লিফটের দরজার কাছে। রানাও চলল পেছন পেছন। লিফটের মুখে পৌঁছে দেখল মৃতদেহের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে লোকটা বিবর্ণ মুখে। একবিন্দু রক্ত নেই চেহারার কোথাও।
ইয়াল্লা! বলল রানা চোখ কপালে তুলে। লোকটা অসুস্থ মনে হচ্ছে?
অসুস্থ? কী বলছেন অসুস্থ? কটমট করে চাইল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। রানার দিকে। ওর ঘাড়টা দেখে বুঝতে পারছেন না? মারা গেছে।
সত্যিই তো! খোদা! ঠিকই বলেছেন মনে হচ্ছে। সামনে ঝুঁকে এসে ভাল করে দেখবার ভান করল রানা। লোকটাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে?
আপনার ফ্লোরের ওয়েটার ছিল ও। কথাটা বলতে বলতে চোখজোড়া ছোট হয়ে এল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের। কিছু একটা যেন বুঝত্বে শুরু করেছে সে।
তাই বলুন, সোজা হয়ে দাঁডাল রানা। সেইজন্যেই চেনা চেনা লাগছিল। আহা, অল্প বয়সেই বেচারী দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। রেস্তোরাঁটা কোনদিকে?
আকাশ থেকে পড়ল নোকটা রানার নির্বিকার প্রশ্ন শুনে।
কি বললেন? রেস্তোরাঁ…
ঠিক আছে, আমিই খুঁজে নেব। হাত নেড়ে আশ্বস্ত করবার ভঙ্গিতে বলল রানা। বুঝতে পারছি, খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন আপনি।
.
হোটেল কার্লটনের রেস্তোরাঁর খ্যাতি শুনেছে রানা আগেই, আজ প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে স্বীকার করে নিল, এখানকার বাবুর্চির রান্নার তুলনা হয় না। ক্যাভিয়ার থেকে শুরু করে অসময়ের তাজা স্ট্রবেরী পর্যন্ত নিখুঁত, অপূর্ব। সোহানা আর মারিয়ার কথা একবার মনে হলো ওর তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে গিয়ে। সামান্য একটু হাসির আভাস খেলে গেল ওর ঠোঁটে। নরম সোফায় হেলান দিয়ে ব্র্যান্ডির গ্লাসটা তুলল সে ওপর দিকে, হাসিমুখে বলল, অ্যামস্টার্ডাম!
অ্যামস্টার্ডাম! বলল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড। সিটি পুলিসের ডেপুটি হেড কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড মিনিট পাঁচেক হলো বিনা আমন্ত্রণেই এসে যোগ দিয়েছে রানার সঙ্গে। রানার সামনে একটা বড়সড় চেয়ারে বসেছে লোকটা, কিন্তু বসার পর মনে হচ্ছে চেয়ারটা ছোট। ভদ্রলোকের দৈর্ঘ্য মাঝারি, কিন্তু প্রস্থ বিশাল। চুলগুলো লোহাটে সাদা, চোখেমুখে নিভকি একটা ভাব, সেইসঙ্গে রয়েছে একটা ক্ষমতার বিচ্ছুরণ–এক নজর দেখলেই বোঝা যায়, কেবল উচ্চপদস্থ কর্মচারীই নয়, ভদ্রলোক অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এবং যোগ্য। শুষ্ক কণ্ঠে বলল, বেশ আমোদেই আছেন দেখছি, মেজর রানা? এতকিছু ঘটার পরও। ভাল, ভেরি গুড।
হেসে নাও, দুদিন বই তো নয়। কিন্তু…এতকিছু কি ঘটল?
রানার এই হালকা ভাবটা পাত্তা দিল না কর্নেল। ধৈর্যের সঙ্গে বলল, ওই ইসমাইল আহমেদ সম্পর্কে কোন কিছুই জানা গেল না।
কোন ইসমাইল আহমেদ? শিফল এয়ারপোর্টে যে খুন হয়েছিল, সেই লোকটা?
হ্যাঁ। শুধু এইটুকু জানা গেছে–মাস তিনেক আগে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে এসেছিল লোকটা, উঠেছিল হোটেল স্কিলারে, কিন্তু এক রাত্রি ওখানে থাকার পর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, আর কোন খোঁজ ছিল না। যতদূর মনে হয়, আপনি যে প্লেনে এসেছেন সেই প্লেনের কোন যাত্রীর সঙ্গে। দেখা করতে গিয়েছিল লোকটা শিফল এয়ারপোর্টে। একজন বাঙালী এয়ারপোর্টে গেল কাউকে রিসিভ করতে, খুন হয়ে গেল, দেখা যাচ্ছে সে প্লেনের একমাত্র বাঙালী যাত্রী পিছু ধাওয়া করছে খুনীর, অথচ নিহত লোকটার। সঙ্গে পরিচয় ছিল বলে স্বীকার করছে না-এসব থেকে আপনার কি মনে হয়?
আমার মনে হয় লোকটা আমার সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিল শিফল. এয়ারপোর্টে, বলল রানা। কারণ আগে হোক আর পরে থোক, ইসমাইলের পরিচয় বের করে ফেলবে ডি গোল্ড। আমারই লোক।
আশ্চর্য ব্যাপার, বলল ডি গোল্ড মস্ত এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, কিন্তু। একবিন্দুও অবাক হয়েছে বলে মনে হলো না তার চেহারা দেখে। দেখুন। মেজর রানা, এটা বড়ই অন্যায় কথা। আমার দেশে আপনার লোক অপারেট করবে, অথচ আমি তার বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানব না…তাহলে কাজ চলবে কি করে?.আমাদের আগেই জানানো উচিত ছিল ওর কথা। এই যেমন আপনার। ব্যাপারে ইন্টারপোল থেকে ইনস্ট্রাকশন পেয়েছি আমরা, সব রকমে আপনাকে সাহায্য করবার অনুরোধ জানানো হয়েছে আমাদের। আপনার কি মনে হয় না, এই রকম পারম্পরিক সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে কাজ করলে আমাদের সবার জন্যেই মঙ্গল হয়? সেক্ষেত্রে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি, আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন, তাই না? ব্র্যান্ডির। গ্লাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিল ডি গোল্ড। ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে চাইল রানার চোখে। আন্দাজ করা যাচ্ছে, জরুরী কোন তথ্য ছিল এই লোকটার কাছে গেল এখন সব। অথচ আমাদের যদি অ্যালার্ট করা হত, ব্যাপারটা নাও ঘটতে পারত।
হয়তো। বলল রানা। ঠিক আছে, আপনার তরফ থেকে আমাকে খানিকটা সাহায্যের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা শুরু করা যেতে পারে। আপনাদের ফাইলটা একটু দেখে আমাকে জানাতে পারবেন মিস বিট্রিক্স শেরম্যানের নামে কিছু এন্ট্রি আছে কিনা? মহিলা একটা নাইট-ক্লাবে কাজ করে।
এয়ারপোর্টে যাকে ধাক্কা মেরেছিলেন? কি করে জানলেন ও নাইট-ক্লাবে কাজ করে?
ও নিজেই বলেছে আমাকে। চোখের পলক না ফেলে ঝাড়া মিথ্যে কথা বলল রানা।
ভ্রূ কুঁচকাল ডি গোল্ড। কিন্তু এয়ারপোর্ট অফিশিয়ালরা তো এই ধরনের কোন মন্তব্য করেনি তাদের রিপোর্টে?