কে পাঠিয়েছে তোমাকে?
লোকটা খুবই টাফ, টের পেয়েছে রানী, কিন্তু ঠিক কতটা তা কল্পনাও করতে পারেনি। এই অবস্থায় ব্যথায় আর ভয়ে আধমরা হয়ে যাওয়ার কথা লোকটার, কিন্তু কোথায় কি–পাই করে ঘুরল সে ডানদিকে, এক ঝটকায়। ছাড়িয়ে নিল হাতটা। পরমুহূর্তে ঝাঁপ দিল সামনের দিকে। যাদুমন্ত্রবলে দশ ইঞ্চি লম্বা একখানা ক্ষুরধার ছুরি চলে এসেছে ওর বাম হাতে। সেকেন্ডের চারভাগের একভাগ সময়ের জন্যে হকচকিয়ে গিয়েছিল রানা, সেই সুযোগে ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে ওর বুকের কাছে নিয়ে এল সে ছুরিটা। কিছুমাত্র চিন্তা করবার সময় পেল না রানা, আত্মরক্ষার তাগিদে খপ করে দুই হাতে ধরে ফেলল। লোকটার কব্জি, ধরেই শুয়ে পড়ল পেছন দিকে, হাত ধরে জোরে টান দিল। নিচের দিকে, সেইসঙ্গে ডান পা-টা ওর তলপেটে বাধিয়ে প্রাণপণে লাথি দিল। ওপর দিকে। রানার শরীরের ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল লোকটা ঘরের কোণে, মাথা নিচু, পা উঁচু অবস্থায় দড়াম করে ধাক্কা খেলো দেয়ালের গায়ে, তারপর চারফুট উঁচু থেকে হুড়মুড় করে পড়ল মেঝের কার্পেটের ওপর। কেপে উঠল সারাটা ঘর। সঙ্গে সঙ্গে কড়াৎ করে বিশ্রী একটা শব্দ এল রানার কানে।
লোকটাকে মাথার ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিয়েই তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছিল। রানা আক্রমণের মোকাবিলার জন্যে, আওয়াজটা শুনেই বুঝতে পারল তাড়াহুড়োর আর কোন দরকারই নেই। দেয়াল বরাবর শুয়ে আছে লোকটা, মাথাটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে টেনে বসাবার চেষ্টা। করল রানা লোকটাকে। মাথাটা ঝুলে পড়ল বুকের কাছে। কব্জি টিপে পালসটা দেখে নিয়েই ওকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা। দুঃখ হলো লোকটা কোন তথ্য না দিয়েই বেরসিকের মত টপ করে মরে যাওয়ায়।
লোকটার পকেট থেকে নানান ধরনের জিনিস বেরোল রুমাল, চিরুনি, হাতে তৈরি গাঁজার সিগারেট, আইডেন্টিটি কার্ড, বলপয়েন্ট কলম, অর্ডার লিখবার স্ক্র্যাপ প্যাড, ইত্যাদি হরেক রকম আইটেম। প্রত্যেকটা ভালমত পরীক্ষা করে রেখে দিল রানা যথাস্থানে, শুধু স্ক্র্যাপ প্যাডের মাঝামাঝি জায়গা। থেকে খসিয়ে নিল একটা কাগজ। কাগজের ওপর লেখা MOO 144, তার। নিচে আরও দুটো নম্বর 910020 আর 2797.
এসব লেখার মানে কিছুই বোধগম্য হলো না রানার কাছে, তবে কিছু একটা অর্থ থাকতে পারে মনে করে রেখে দিল সে কাগজের টুকরোটা প্যান্টের এক গোপন পকেটে। এক মিনিটের মধ্যেই ঘরটা গোছগাছ করে নিল রানা–ধস্তাধস্তির কোন চিহ্ন রইল না আর। পকেট থেকে ফ্লোর ওয়েটারের পিস্তলটা বের করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল সে; খাল লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল। সেটা বাম দিকে; কয়েক সেকেন্ড পর হালকা একটা ঝপাং আওয়াজ পেয়ে ফিরে এল আবার ঘরে। জানালাগুলো খুলে ফ্যান চালিয়ে দিল ফুলফোর্সে। সিটিংরূমে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে এল সে লাশটা। করিডরের দরজা ফাঁক করে চোখ রাখল, কেউ নেই কান পাতল, পায়ের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না কারও। দ্রুতপায়ে লিফটের সামনে চলে এল রানা, বোতাম টিপে দাঁড়িয়ে রইল। খালি লিফট এসে থামল রানার সামনে। ভিতরে না ঢুকে পকেট থেকে একটা ম্যাচবাক্স বের করল রানা, দরজাটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ম্যাচবাক্সটা গুঁজে দিল দুই দরজার ফাঁকে। ইলেকট্রিক্যাল। সারকিট কমপ্লিট করতে না পেরে আবার দুপাশে খুলে গেল দরজাটা, আবার ফিরে এল, ম্যাচবাক্সের গায়ে বাধা পেয়ে আবার হাঁ হয়ে গেল খুলে। একছুটে নিজের কামরায় ফিরে এল রানা, টেনেহিঁচড়ে লাশটা নিয়ে গিয়ে পুরে দিল। লিফটের মধ্যে। ম্যাচবাক্সটা বের করে নিতেই এবার ক্লিক করে লেগে গেল দরজা। লেগে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সেটা যেখানে ছিল সেখানেই। নিচে থেকে কেউ বোম না টিপলে থাকবে ওটা ওখানেই।
বাইরে থেকে নিজের কামরায় নকল চাবি দিয়ে তালা মেরে আবার ফায়ার এসকেপের মধ্যে গিয়ে ঢুকল রানা, দ্রুতপায়ে নেমে এল নিচে। এপাশ ১ ওপাশ দেখে নেমে পড়ল রাস্তায়। লম্বা পা ফেলে মেইন রোডে বেরিয়ে এল রানা, সদর দরজা দিয়ে ঢুকল এবার হোটেলে।
সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের সঙ্গে আরও দুজন ইউনিফরম পরা সহকারী ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে রিসিপশন ডেস্কের ওপাশে। বেশ জোরে হাঁক ছাড়ল রানা, ছশো বাইশ।
রানার দিকে পেছন ফিরে ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, সঁই করে ঘুরল গলার আওয়াজ পেয়ে। চট করে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিল, সামলে নিল। তারপর রানার দিকে চেয়ে হাসল ওর ঝকঝকে হাসি।
মিস্টার রানা, আপনি বাইরে গিয়েছিলেন, জানতাম না?
মনে মনে রানা বলল ঠিকই জানতে চাঁদ, এক্ষুণি ফ্লোর ওয়েটারকে সাবধান করতে যাচ্ছিলে। কিন্তু মুখে বলল, এই খানিক ঘুরে ফিরে হেঁটে এলাম আর কি। খিদে বাড়িয়ে আনলাম।
চাবিটা নিয়ে ধীরে সুস্থে লিফটের দিকে এগোল রানা। বেশিদূর যেতে হলো না, অর্ধেক পথ গিয়েই থমকে দাঁড়াল সে সাইরেনের মত তীক্ষ্ণ চিৎকারে। পাঁচ সেকেন্ড পর থামল সাইরেন, তিন সেকেন্ড চারপাশে পিন। পতন স্তব্ধতা, পুরো দম নিয়ে আবার খিচে আর্তনাদ ছাড়ল লিফটের সামনে দাঁড়ানো মহিলা। রঙচঙা কাপড় পরা মাঝবয়সী মহিলা, দুই চোখ বিস্ফারিত, মুখের গোল হাঁ দিয়ে পুরো একটা দুটাকা দামের রসগোল্লা ঢুকিয়ে দেয়া যায়। অনায়াসে। মহিলাকে থামাবার চেষ্টা করছে তার পাশে দাঁড়ানো এক বয়স্ক ভদ্রলোক, কিন্তু বেচারার নিজের অবস্থাও মহিলার চেয়ে কোন দিক থেকে ভাল নেই, রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখে এপাশ ওপাশ চাইছে বৎসহারা গাভীর মত। দেখে মনে হচ্ছে, সেও খানিক চিৎকার করতে পারলে বেঁচে যেত।