মাথা ঝাঁকাল রানা। রেভারেন্ড ডক্টর নিকোলাস রজারকে ভাল না লেগে উপায় নেই কারও।
ইরিনকে মনে হলো ভদ্রলোকের খুব বড় ভক্ত একজন। আপনাকে যেভাবে ধরেছিল, সেইভাবে জড়িয়ে ধরল বুড়ো লোকটার গলা, কানে কানে কি যেন বলল। ভদ্রলোক কথাটা শুনে এমন ভাব করলেন যেন চমকে গেছেন মেয়েটার প্রস্তাবে। আসলে ভান। হাসিমুখে পকেট থেকে কি যেন বের করে গুঁজে দিলেন ইরিনের হাতে। খুব সম্ভব পয়সা। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে। দাঁড়াল মেয়েটা, লাফাতে লাফাতে ছুটল একটা আইসক্রীম ভ্যানের দিকে। আইসক্রীম কিনে সোজা হাঁটতে লাগল আমার দিকে।
তুমি ভাগলবা?
আরও খানিকটা উঁচু করে ধরলাম ম্যাগাজিনটা। গভীরভাবে বলল মারিয়া। আমার সামনে দিয়ে চলে গেল ও বিশ গজ দূরে দাঁড়ানো আরেকটা খোলা ভ্যানের দিকে!
পুতুল দেখতে?
আপনি জানলেন কি করে? জানা খবর জানাচ্ছে মনে করে হতাশ হয়ে পড়ল মারিয়া।
আন্দাজ। অ্যামস্টার্ডামে ভ্যান বলতে প্রতি দুটোর মধ্যে একটা পুতুল বিক্রির ভ্যান বোঝায়।
তারপর পুতুল ঘাটাঘাটি শুরু করল মেয়েটা। কোনটা কোলে নেয়, কোনটাকে চুমো খায়। ফেরিওয়ালা বুড়ো রেগে ওঠার চেষ্টা করল বারকয়েক, কিন্তু, অমন একটা মেয়ের ওপর কি রাগ করা যায়? ভ্যানের ওপাশে চলে গেল মেয়েটা। কোলের পুতুলটাকে আইসক্রীম সাধছে। বারবার।
এই সময়ে বুড়ো আর বুড়ি কি করছিল?
গল্প করছিল। নাকে-মুখে কথা বলছিলেন বুড়ো ভদ্রলোক, মাথা। ঝাঁকাচ্ছিল বুড়ি। খানিক বাদেই ফিরে এল ইরিন। তিনজনে গল্প করল আরও কিছুক্ষণ, তারপর ইরিনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে উঠে পড়লেন প্যাসটর, বাকি দুজনও রওনা হয়ে গেল বাড়ির পথে।
প্যাসটর আলাদা, বাকি দুজন আলাদা?
হ্যাঁ।
এদের কাউকে অনুসরণ করবার চেষ্টা করেছিলে?
না।
গুড গার্ল। তোমাকে কেউ অনুসরণ করেছিল?
মনে হয় না।
অর্থাৎ, শিওর না?
অনেকেই সেই সময় পার্ক ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। কেউ অনুসরণ করছে, কিনা বোঝার উপায় ছিল না। নিশ্চিত হয়ে কিছুই বলা যায় না। তবে ফিরে আসবার সময় সোহানার সাথে দেখা হয়ে গেল মাঝপথে, তিনবার ট্যাক্সি আর দুইবার ট্রাম বদলে এই হোটেলে পৌঁছেছি–মনে হয় না, কেউ অনুসরণ করতে পেরেছে।
এবার সোহানা। সোহানার দিকে ফিরল রানা।
হোস্টেল প্যারিসের ঠিক উল্টোদিকে একটা কাফে আছে। সেটার মধ্যে ঢুকে বসেছিলাম আমি। অনেক মেয়েই ঢুকল বেরোল। চতুর্থ কাপ কফি শেষ করে একটা মেয়েকে পেয়ে গেলাম–কাল রাতে দেখেছি ওকে গির্জায়। লম্বা, ব্রুনেট, দারুণ দেখতেতুমি একবার দেখলেই…
প্রেমে পড়ে যেতাম? অসম্ভব। তোমাদের দুইজনের প্রেমেই অস্থির হয়ে। আছি, প্রাণ যায় যায়। আপাতত আর কারও প্রেমে পড়ার তেমন ইচ্ছে নেই। কাল নানের বেশে দেখেছ তুমি ওকে। কি করে বুঝলে ব্রুনেট কিনা? চুল তো আর দেখতে পাওনি?
বাম গালে একটা আঁচিল ছিল মেয়েটার।
লাল আঁচিল? চীফ বোনের উপর না? সবুজ চোখ? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।
হ্যাঁ, হ্যাঁ-ওই মেয়েটাই। ধিঙ্গিমার্কা হাঁটা। হাল ছেড়ে দিল রানা। বুঝল, এসব ব্যাপারে কোনরকম সন্দেহ পোষণ করবার কোন মানে হয় না। অকপটে আস্থা রাখা যায় মেয়েদের উপর। এক সুন্দরী মেয়ে যখন আরেক সুন্দরী মেয়েকে দেখে তখন লঙরেঞ্জ দুরবীন হয়ে যায় ওদের চোখ। ওই মেয়েটার পেছন পেছন ক্যালভারস্ট্রাটে গিয়ে পৌঁছুলাম, বলে চলল সোহানা। বিরাট একটা দোকানে ঢুকল মেয়েটা। প্রথমটায় মনে হলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবোলতাবোল, কিন্তু দেখলাম খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেই, সুভ্যেনির, এক্সপোর্ট ওনলিলেখা একটা কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াল। এটা-ওটা-সেটা ঘাটাঘাটি করছে ঠিকই, কিন্তু পাপেটগুলোর প্রতিই যে ওর আসল আগ্রহ। বুঝতে পারলাম আমি পরিষ্কার।
চমৎকার! বলল রানা। আবার সেই পুতুল। কি করে বুঝলে ওর আগ্রহটা ওই দিকেই?
এমনিই বুঝতে পারলাম, এমন সুরে বলল সোহানা যেন জন্মান্ধকে রঙের পার্থক্য বোঝাবার চেষ্টা করছে। দেখলাম, বিশেষ এক ধরনের পুতুলের প্রতিই ওর আগ্রহ বেশি, নাড়াচাড়া করছে। আমি বুঝলাম, ওটা নোক দেখানো, কোনটা কিনবে ঠিক করাই আছে ওর মনে মনে। এটা ওটা নেড়েচেড়ে শেষ পর্যন্ত পুতুল পছন্দ করল, একজন সেলসম্যানকে কিছু বলল, লোকটা কি যেন লিখে দিল একটা কাগজের টুকরোয়।
কতক্ষণ লাগল লিখতে?
বেশি না। একটা ঠিকানা লিখতে যতটা সময় লাগে, ততটা। দাম চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল মেয়েটা।
ওকে অনুসরণ করলে তুমি?
না। দেড়টায় মারিয়ার সাথে দেখা করবার কথা ছিল, তাই দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিলাম অন্যপথে। আমিও গুড গার্ল, না?
হ্যাঁ।
কেউ অনুসরণ করেনি আমাকে। বলেই হাসল। খুব সম্ভব।
দ্যাটস গুড। কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল রানা, তারপর ঘোষণা করল, ওয়েল ডান। অকম্মার টেকি তোমরা। আই লাভ ইউ বোথ।
চোখ মটকে পরস্পরের দিকে চাইল সোহানা আর মারিয়া। সিরিয়াস টাইপের মেয়ে মারিয়া ডুক্লজ। প্রথম দিকে যথেষ্ট গাম্ভীর্যের সাথে গ্রহণ করেছিল রানাকে, কিন্তু গত দুইদিনে কিছুটা সোহানার কাছ থেকে শুনে, কিছুটা নিজে থেকেই পরিষ্কার বুঝে নিয়েছে সে রানার চরিত্র। পৃথিবীর সেরা দশজন স্পাইয়ের একজন রানা, জানা আছে ওর, ভেবেছিল, না জানি কেমন দাপট আর অহঙ্কার থাকবে লোকটার। ভয়-ভয় একটা ভাব ছিল ওর পুরো একটা দিন। কিন্তু যে মুহূর্তে বুঝতে পেরেছে আশ্চর্য এক করুণার ধারা, রয়েছে এই গভীর লোকটার বুকের ভেতর, যন্ত্র নয়–সত্যিকার মানুষের মতই মায়া-মমতা আর গভীর সহানুভূতি রয়েছে ওর মানুষের জন্যে, বাইরের শক্ত খোলসের আড়ালে রয়েছে একটা হাসিখুশি, নিরহঙ্কার অমায়িক মন, সেই মুহূর্তেই দূর হয়ে গেছে ওর সমস্ত ভয়। সোহানার মতই সহজভাবে গ্রহণ করেছে সে রানাকে। বলল, দ্যাট ইজ ভেরি নাইস অফ ইউ।