ঘণ্টাদেড়েক শুয়ে শুয়ে পাতা ওল্টাল রানা ভুলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানী থেকে পাওয়া ইনভয়েস ফাইলের। বিভিন্ন প্রস্তুতকারকের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের মাল সাপ্লাই পেয়েছে এরা। কিন্তু কয়েকশো ইনভয়েস ঘাটতেই একটা নাম ঠিকানা প্রায় মুখস্থ হয়ে গেল রানার। গত ছয়মাসে কমপক্ষে বিশ বার মাল সাপ্লাই দিয়েছে এরা এই কোম্পানীকে। মালের ধরনটা রানার ধারণার সাথে মিলে গেল অনেকটা মনে মনে বারকয়েক উচ্চারণ করে ঠিকানাটা মুখস্থ করে নিল সে।
ক্লিক শব্দ তুলে তালা খুলল দরজার, ঘরে ঢুকল সোহানা আর মারিয়া। রানাকে দেখামাত্রই একটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল দুজনের চোখেমুখে, পরমুহূর্তে বিরক্ত ভঙ্গিতে ভ্রূ কোঁচকাল ওরা একসাথে। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল রানা, কি ব্যাপার? ঘটনা আছে বলে মনে হচ্ছে?
আমাদের এরকম বোকা বানাবার কি অর্থ? ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল। মারিয়া। ডেস্কের লোকটা বলল লাউঞ্জে অপেক্ষা করছেন.আপনি আমাদের। জন্যে…এটা কি লাউঞ্জ হলো?
আধঘণ্টা হাঁ করে বসে থাকলাম আমরা লাউঞ্জে, বলল সোহানা। চলে গেছ মনে করে ফিরে এলাম ঘরে। না এলে আরও কয়ঘণ্টা বসে থাকতে হত ওখানে কে জানে!
ক্লান্তি লাগছিল খুব, একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম, বলল রানা। যাই হোক, মাফটাফ চাওয়া হয়ে গেল, এবার শোনা যাক কে কতদূর কি করলে?
কোথায় মাফ চাওয়া হলো? একেবারে আকাশ থেকে পড়ল মারিয়া। একটু নরম করে কথা বলা মানেই মাফ চাওয়া এবং পাওয়া হয়ে গেল?
বসদের জন্যে ওটুকুই যথেষ্ট। এবার কাজের কথা কে শুরু করবে, তুমি, না সোহানা?
খুব বেশি কিছু বলবার নেই। আপনার সেই বিট্রিক্স শেরম্যান
পালিয়েছে। তোমাদের মেসেজ পেয়ে আমি খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। ভেগেছে।
ভেগেছে মানে?
দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
দেশ ছেড়ে পালিয়েছে?
এথেন্সে।
কেন?
ভয়ে। ওর এক কাঁধে ভর করেছিল খারাপ লোক, আরেক কাঁধে ভাল। লোক–মানে, আমি। দিশে হারিয়ে একেবারে পগার পার হয়ে গেছে।
কি করে জানলে যে সত্যিই পালিয়েছে ও?
ব্যালিনোভার ম্যানেজারের কাছে শুনলাম, তারপর এয়ারপোর্টে ফোন। করেও জানা গেল, ব্যাপারটা সত্যি।
বেশ। তাহলে একটা ঝামেলা চুকল। এবার অন্য কাজের রিপোর্ট দেয়া। যাক। কারটা শুনবে আগে…আমি, না মারিয়া।
আগে এটা দেখো। একটা কাগজের টুকরো এগিয়ে দিল রানা সোহানার দিকে। তার উপর স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা রয়েছে 910020 দেখো তো এর কোন অর্থ বের করা যায় কিনা?
নানান ভাবে দেখল সোহানা নম্বরটা–সোজা করে, উল্টে নিয়ে, কাত করে। কাগজের উল্টোপিঠ দেখল। তারপর মাথা নাড়ল। নাহ। আমার মাথায় ঢুকছে না কিছু।
দেখি, আমি দেখি? হাত বাড়াল মারিয়া। ক্রসওয়ার্ডে আমার তুলনা হয় না। সত্যিই তুলনা হয় না। কাগজটা হাতে নিয়ে তিন সেকেন্ড ওটার দিকে চেয়ে থেকে বলল, নম্বরটা উল্টে নিন। জিরো টু ডাবল জিরো ওয়ান নাইন। রাত দুটোউনিশ তারিখ। অর্থাৎ আগামীকাল রাত দুটো। ঠিক এগারো ঘণ্টা পর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
প্রশংসার দৃষ্টি ফুটে উঠল রানার চোখে। মুখে বলল, দারুণ! মারিয়া। যেটী তিন সেকেন্ডে বুঝে ফেলেছে সেটা বের করতে ওকে প্রায় দেড়ঘণ্টা ব্যয়। করতে হয়েছিল।
কি ঘটতে চলেছে? সরাসরি জানতে চাইল সোহানা।
লেখক সেটা উল্লেখ করতে ভুলে গেছে। সোহানা, মারিয়া দুজনেই বুঝল কিছু একটা চেপে যাচ্ছে রানা ওদের কাছে, এ-ও বুঝল যে রানা জানে। যে ওরা বুঝে ফেলেছে। কাজেই আপাতত চুপ করে রইল ওরা দুজনেই। রানা বলল, মারিয়া তুমি ফাস্ট হয়েছ, তোমার রিপোর্ট দিয়েই শুরু করা। যাক।
এই নতুন ড্রেসটা পরলাম, কারণ এটা ইরিন দেখেনি আগে। বাতাস ছিল, একটা স্কার্ফও জড়িয়ে নিয়েছিলাম মাথায়। সেইসাথে…
একটা গাঢ় রঙের সানগ্লাস পরে নিয়েছিলে চোখে। বলল রানা।
হ্যাঁ। রানার সানগ্লাসের কথা বলবার অর্থ আজেবাজে বিবরণ বাদ দিয়ে আসল কথায় এসো, বুঝল মারিয়া, কিন্তু পাত্তা দিল না। অফিশিয়াল রিপোর্টে কোথাও ফাঁক রাখবার অভ্যেস তার নেই, একেবারে নিখুঁতভাবে কর্তব্য পালন করতে না পারলে ভাল লাগে না ওর। বলল, একটু আগেই চলে গিয়েছিলাম। আধঘণ্টা রিটায়ার্ড বুড়ো আর বাচ্চাদের প্র্যামের ভিড় বাঁচিয়ে ঘুরলাম এদিক ওদিক। তারপর দেখতে পেলাম ওকে। ওকে ঠিক না, ওর সাথের সেই বিশাল মোটা বুড়িটাকে। ঠিক পুতুলের মত ড্রেস। পাশেই ইরিন। সাদা একটা ফুলহাতা কটন ড্রেস পরেছে, কোথাও একদণ্ড স্থির থাকতে পারছে না, সর্বক্ষণ তিড়িং বিড়িং লাফাচ্ছে বাচ্চা ছাগলের মত। একটু থেমে বলল, মেয়েটা দেখতে কিন্তু খুবই সুন্দরী।
তোমার অন্তরটা মহৎ, মারিয়া।
ইঙ্গিতটা বুঝল মারিয়া। বলল, যাই হোক, খানিক ঘোরাঘুরি করে, পায়রাদের বুট খাইয়ে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল ওরা। আমিও গজ তিরিশেক দুরে একটা বেঞ্চে বসে একটা ম্যাগাজিনের উপর দিয়ে চোখ রাখলাম ওদের ওপর। ডাচ ম্যাগাজিন।
চমৎকার! তারপর?
তারপর পুতুলের চুল আঁচড়াতে শুরু করল ইরিন। আমি…
দাঁড়াও, দাঁড়াও। পুতুল? পুতুল কিসের?
বলিনি বুঝি? বড়সড় একটা পুতুল ছিল ওর হাতে। চুল আঁচড়াচ্ছে, এমনি সময় দোহারা চেহারার একজন লোক এসে বসলেন ওদের পাশে। কালো একটা ওভারকোট, প্রিস্ট কলার, সাদা গোফ, মাথাভর্তি ধবধবে পাকা চুল। খুব ভাল লোক বলে মনে হলো।