এই তো বাছার মুখ ফুটেছে। আবার আঘাত করবার ভঙ্গিতে পিস্তলটা উঁচু করল রানা। কিন্তু আঘাত না করে জিজ্ঞেস করল, বিট্রিক্স শেরম্যান কোথায় কাজ করে?
মারের ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল গুডবডি, প্রশ্নের উত্তরে চট করে জবাব দিল, এখানে।
কোথায় ও?
জানি না। আপন গড, সত্যিই জানি না। রানাকে আবার পিস্তল তুলতে দেখে শেষের শব্দ দুটো বলতে গিয়ে কয়েক পর্দা চড়ে গেল ওর কণ্ঠস্বর। কানের উপর ঠিক একই জায়গায় ঠকাশ করে বাড়ি পড়ল পিস্তলের বাটের। ফুঁপিয়ে উঠল লোকটা। কিছু বললে ঠিক দুই ঘণ্টার মধ্যে মারা পড়ব আমি!
না বললে মারা পড়বেন দুই সেকেন্ডের মধ্যে। কোনটা ভাল? আবার হাত তুলল রানা। কি? বলবেন?
বলব।
কোথায় ও?
পালিয়ে গেছে। এথেন্সে।
এথেন্সে?
হ্যাঁ। ভোরবেলায় এসেছিল এখানে। দুমাসের বেতন পাওনা ছিল, সেই টাকার জন্যে।
একা?
না, ওর ভাইও ছিল সঙ্গে। দুজনেই পালিয়েছে। আজ সাড়ে দশটার। ফ্লাইটে। বিশ্বাস না হয় ফোন করে জেনে দেখতে পারেন এয়ারপোটে। আমি নিজেই এই কিছুক্ষণ আগে…
রানাকে একটু আন্ডার-এস্টিমেট করেছিল লোকটা। মনে করেছিল, আরও দুতিনটা সেকেন্ডের জন্যে আকর্ষণ করে রাখতে পারবে ওর মনোযোগ। অবাক হলো রানার ঠোঁটে মৃদুহাসি খেলে যেতে দেখে। পাই করে ঘুরেই লাথি চালাল রানা।
পিস্তল বের করে ফেলেছিল স্যামুয়েল। খটাং করে লাথি এসে লাগল ওর কনুইয়ের নিচে হাড়ের উপর। সাঁ করে উড়ে গিয়ে পিস্তল পড়ল ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে। ওর পাজরের উপর আরেকটা লাথি লাগিয়ে উঠে বসবার ইঙ্গিত করল রানা। ফিরল গুডবড়ির দিকে। পিস্তল দিয়ে টেলিফোনের দিকে ইশারা করে বলল, ডায়াল করুন।
ডায়াল করে তিনবারের চেষ্টায় কানেকশন পেল গুডবডি, রানার দিকে এগিয়ে দিল রিসিভারটা।
আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার বলছি, বুলল রানা। আজকের এথেন্স ফাঁইট সম্পর্কে জানতে চাই খুব সম্ভব কে এল। এমই হবে। বিট্রিক্স শেরম্যান আর হেনরী শেরম্যান বলে দুজন কি এই। ফ্লাইটে কী বললেন?
অপর প্রান্ত থেকে পরিষ্কার কণ্ঠে উত্তর এল, আজ সকাল সাড়ে দশটার। ফাঁইটে এরা দুজন চলে গেছেন এথেন্সে। হেনরী শেরম্যানের ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি উঠেছিল, কিন্তু তেমন কোন অসুবিধে হয়নি, দুজন একসাথেই উঠেছেন প্লেনে।
ধন্যবাদ জানিয়ে নামিয়ে রাখল রানা রিসিভার।
গুডবডি আর সাপের বাচ্চা স্যামুয়েলকে ঘরের এককোণে পেছন ফিরে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এল রানা। দরজায় তালা মেরে দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে চাবিটা ঢুকিয়ে দিল কার্পেটের নিচে। অ্যালার্ম বেল। রয়েছে, টেলিফোন রয়েছে, স্পেয়ার কী সংগ্রহ করে এই ঘর থেকে বেরোতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না ওদের। দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল সে। ব্যালিনোভার সদর দরজা খুলে।
বিট্রিক্সের এই হঠাৎ অন্তর্ধানে বেশ দুঃখই বোধ করল রানা। সাহায্য করব বলে করেনি, সেজন্যে নয়; নিজের অজান্তেই নিজেরই সব পথ বন্ধ করে দিল বেচারী। ওর উপর ভরসা রাখতে পারেনি মেয়েটা। একটি মাত্র কারণে ওর প্রভুরা এখনও খুন করেনি ওকে–ওরা জানে এই হত্যার সাথে জড়িয়ে। দেবে রানা ওদের।
এখন আর কোন বাধাই রইল না।
.
০৩.
বন্দরের কাছেই বিশাল স্কাইস্ক্র্যাপার হ্যাঁভেঞ্জবো। এর ছাতে দাঁড়ালে গোটা অ্যামস্টার্ডাম শহরটা দেখতে পাওয়া যায় এক নজরে। চমৎকার দৃশ্য। কিন্তু দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে ওঠেনি রানা এখানে।
জোর হাওয়া বইছে সমুদ্রের দিক থেকে। শীতল। ঝলমল করছে চারদিক উজ্জল রোদে। উদ্বেল সমুদ্রে ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা। রানার চোখে বিনকিউলার। চেয়ে রয়েছে দূর সমুদ্রের দিকে।
অবজার্ভেশন প্ল্যাটফর্মে টুরিস্টদের ভিড়ে মিশে গেছে রানা। কাঁধে ক্যামেরা হাতে বিনকিউলার-আর সব টুরিস্টদের থেকে আলাদা করবার। কোন উপায় নেই। এপাশ-ওপাশ থেকে মুগ্ধ বিস্ময়ের ধ্বনি ভেসে আসছে ওর, কানে, হাওয়ায় উড়ছে মহিলা টুরিস্টদের চুল, একদল আসছে, দেখছে ঘুরে। ফিরে, চলে যাচ্ছে, আবার আসছে আরেক দল, কিন্তু কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই রানার। স্থির হয়ে রয়েছে ওর দৃষ্টিটা বহুদূরের একটা কোস্টারের উপর। এক হাজার কি বারোশো টনের কোস্টাল স্টীমার, বাঁকা হয়ে ঘুরে ধীরগতিতে গদাই লশকরী চালে এগোচ্ছে জেটির দিকে। এতদূর থেকেও বেলজিয়ান ফ্যাগ দেখতে পেল রানা পরিষ্কার, বাতাসে উড়ছে আগুনের শিখার মত। বয়ালোর একেধারে ধার ঘেঁষে এগোচ্ছে কোস্টারটা। কেন?
অত্যন্ত মনোযোগের সাথে লক্ষ করল রানা ওটার গতিবিধি, ঘাটের কাছে এসে নোঙর ফেলা। ঘড়ি দেখল। দুপুর দেড়টা। ক্যাপ্টেনের সময়জ্ঞান যে টনটনে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু আইন শৃঙ্খলাবোধ যে তেমনি ঢিলে তাতেও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আবছা হলেও নামটা পড়তে পারছে রানা এখন, হলুদ রঙ দিয়ে লেখা আছে ওটার গায়ে-মেরিনো।
এপাশের বার্জ-বন্দরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভালমত দেখে নিয়ে নেমে পড়ল রানা অবজার্ভেশন টাওয়ার থেকে। পথ চলতে চলতে হঠাৎ চোখ পড়ল ওর হ্যাঁভেন রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ডের উপর। খিদে নেই, তবু ঢুকে পড়ল রানা ভেতরে-চাট্টে খেয়ে নেয়া দরকার। পরে আর কবে কখন সুযোগ হবে কে জানে।
দুপুর দুটোর দিকে পৌঁছুল রানা হোটেল প্লাযায়। ডেস্কে জানা গেল ফেরেনি এখনও সোহানা বা মারিয়া। লাউঞ্জে অপেক্ষা করবে, বলল রানা লোকটাকে। একটা সোফায় গিয়ে বসল ও, কিন্তু রিসেপশনিস্ট একটু অন্যমনস্ক হতেই চট করে উঠে পড়ল লিফটে। চারতলায় উঠে সোজা গিয়ে ঢুকল সে সোহানাদের কামরায়। দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল একটা আরামকেদারায়। গদিটা একটু নরম ঠেকল-বোঝা গেল, আগের হোটেলের চেয়ে এটার স্ট্যান্ডার্ড কিছুটা উঁচু; ওটা যদি উনিশ হয়, এটা বিশ।