পাঁচ মিনিট দমাদম দরজা পিটবার পর সামান্য একটু ফাঁক হলো ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাবের সদর দরজাটা। চট করে ফাঁকের মধ্যে জুতোসুদ্ধ। পা ভরে দিয়ে হাত দিয়ে টেনে আর একটু বড় করল রানা ফাঁকটা। একমাথা সোনালি চুল দেখা গেল প্রথমে, তারপর দেখা গেল আবছামত একটা মেয়ে। দাঁড়িয়ে আছে বুকের কাছে চাদর জাতীয় কিছু একটা দিয়ে লজ্জা ঢেকে। গতরাতে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় দেখেছে রানা একে ড্রিঙ্কস সার্ভ করতে, আজ। দিনের বেলা হঠাৎ এর এত লজ্জার কারণ বুঝে উঠতে পারল না সে।
ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই, বলল রানা।
ছটার আগে খুলি না আমরা।
যেটুকু খুলেছ তাতেই চলবে। আমি রিজার্ভেশনের জন্যে আসিনি। চাকরির জন্যেও না। ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই। এই মুহূর্তে।
উনি…উনি তো এখানে নেই।
চাকরিটা খোয়াবার ইচ্ছে আছে? কর্কশ কণ্ঠে বলল রানা। আমি এখানে ইয়ার্কি মারতে আসিনি।
চাকরির কথায় বেশ একটু সতর্ক হয়ে গেল মেয়েটা।
মানে?
কণ্ঠস্বর নিচু করল রানা বক্তব্যে গাম্ভীর্য বাড়াবার জন্যে। মানে হচ্ছে যে, মুহূর্তে ম্যানেজার জানতে পারবে যে আমি দেখা করতে চেয়েছিলাম এবং তুমি বোকার মত ব্যাপারটার গুরুত্ব না বুঝে আমাকে বিদায় করে দিয়েছ, তোমার চাকরিটা নাই হয়ে যাবে।
একটু ইতস্তত করল মেয়েটা, অনিশ্চিত দৃষ্টিতে বারকয়েক দেখল রানাকে আপাদমস্তক, তারপর মৃদু গলায় বলল, একটু অপেক্ষা করুন। বলেই দরজাটা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু রানার জুতোর সোল রয়েছে দুই দরজার ফাঁকে, বারকয়েক দরজা বন্ধ করবার বিফল চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেল ভেতরে। আধ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা এক লোককে সাথে নিয়ে।
এক নজরেই অপছন্দ করল রানা লোকটাকে। বেশির ভাগ মানুষের মতই রানাও সাপ পছন্দ করে না। কিন্তু একে দেখবার সাথে সাথে ওই প্রাণীটার কথাই মনে পড়ল ওর। এই সাপের বগলের কাছে শোলডার হোলস্টারের আভাস টের পেল সে পরিষ্কার। যেমন লম্বা তেমনি চিকন লোকটা, কিন্তু হাতের কব্জি বক্সারের মত চওড়া। ফ্যাকাসে গায়ের রঙ, চলার ভঙ্গিতে নিশাচর হিংস্র জন্তুর ক্ষিপ্রতা। লম্বা নাক, নাকের দুপাশে কাছাকাছি বসানো একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ। ঠোঁটের কোণে সিগারেট। একগাল ধোয়া ছেড়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে পরীক্ষা করল সে রানার নির্বিকার মুখটা।
কি ব্যাপার, মিস্টার? এই সাতসকালে কি চান? এটা নাইট-ক্লাব– দিনে বন্ধ।
আগেই শুনেছি খবরটা। আপনি ম্যানেজার?
অ্যাসিস্ট্যান্ট। আপনি যদি পরে এক সময়ে আসেন–পরে মানে, এই ধরুন, সন্ধে ছটা নাগাদ আসেন, তাহলে হয়তো ম্যানেজারের সাথে একটা ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা..
ইংল্যান্ড থেকে এসেছি, আমি একজন উকিল, অত্যন্ত জরুরী এক ব্যাপারে। থেমে থেমে বলল রানা। একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিল। লোকটার হাতে। এক্ষুণি দেখা করা দরকার আমার ম্যানেজারের সাথে। অনেক টাকার মামলা।
আবার একবার সাপের মত নিষ্পলক দৃষ্টি বোলাল লোকটা রানার উপর। কার্ডটা দেখল। তারপর ঠোঁটে বাকা হাসি টেনে এনে বলল, কোন। কথা দিচ্ছি না, মিস্টার রবার্টসন। ঠিক আছে, কার্ড দেখাই ওকে। হয়তো বলেকয়ে কয়েক মিনিট সময় আদায় করা যাবে ওঁর কাছ থেকে।
লম্বা পা ফেলে চলে গেল লোকটা, ফিরে এল প্রায় সাথে সাথেই। মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করল সে রানাকে সামনে এগোবার জন্যে, সরে দাঁড়িয়ে পথ করে দিল, সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলল পিছু পিছু। এই ধরনের লোক পেছন পেছন হাটলে সবসময় অস্বস্তি বোধ করে রানা, কিন্তু আপাতত কিছুই। করবার নেই, ওপাশের দরজা ঠেলে সরু একটা মান আলোকিত প্যাসেজ ধরে কয়েক পা এগিয়ে ডানদিকে ফিরল। সামনেই একটা ভারী দরজার গায়ে, ছোট্ট নেমপ্লেট-তাতে লেখা ম্যানেজার।
পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে দরজার গায়ে দুটো টোকা দিয়ে হ্যাঁভেলে চাপ দিল লম্বা লোকটা, রানার পিঠে মৃদু চাপ দিল ভেতরে ঢোকার জন্যে। ঢুকে পড়ল রানা।
ছোট্ট অফিসঘর। অত্যন্ত সুসজ্জিত। দুপাশের দুই দেয়াল জুড়ে ফাঁইলিং। ক্যাবিনেট, অন্য দুই দেয়াল ক্রিমসন ও ভায়োলেট রঙের ড্রেপ দিয়ে মোড়া। জানালা আছে কি নেই বোঝা যায় না। কাঁচ ঢাকা মেহগনি-ডেস্কের ওপাশে কাগজপত্রের মধ্যে ডুবে রয়েছে নীল আলপাকা অ্যাটপরা একজন হালকা পাতলা সভ্রান্ত চেহারার মাঝবয়সী লোক। রানা ঢুকতেই চশমাটা খুলে রাখল টেবিলের উপর, আট-দশটা আংটি পরা বামহাতে একটা চোখ ডলতে ডলতে। অন্য চোখ দিয়ে চাইল রানার দিকে।
আসুন, মিস্টার রবার্টসন। উঠে দাঁড়াবার বা হ্যাঁন্ডশেক করবার চেষ্টা করল না সে। বিরক্ত কণ্ঠে বলল, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব সুখী হলাম। বসুন। আমার নাম গুডবডি, আমিও ইংরেজ।
ভদ্রতার হাসি হেসে মাথা ঝাঁকাল রানা, যেন সত্যিই যে ওর নাম গুডবডি তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বসল সামনের চেয়ারে। সাথে সাথেই কাজের কথায় চলে এল গুডবডি।
আমার সাথে জরুরী কোন ব্যাপারে আলাপ আছে আপনার। কি সেটা?
আমার কাজটা ঠিক আপনার সাথে নয়, বলল রানা। আপনার এক কর্মচারীর সাথে।
মুহূর্তে ফ্রিজিং পয়েন্টে চলে এল গুডবডির শীতল দৃষ্টি। আমার কর্মচারীর সাথে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তাহলে আমাকে বিরক্ত করবার মানে?